Friday, April 19, 2024
Homeবাণী-কথাঅনুবাদ গল্পদ্যা মাঙ্কিজ পাও - উইলিয়াম জেকবস্

দ্যা মাঙ্কিজ পাও – উইলিয়াম জেকবস্

'দ্যা মাঙ্কিজ পাও’ - উইলিয়াম জেকবস্

ঝড় বৃষ্টিময় একটা রাত।

শোঁ শোঁ শব্দে ঝোড়ো হাওয়া ঝাপটা মেরে যাচ্ছে জানালায়। শার্শিতে বৃষ্টির ছাট মুক্তার মত ঝলমল করছে রাস্তার আলোর ঝলকানিতে।

বন্ধ ঘরের আড্ডা কিন্তু জমেছে ভালো হোয়াইট পরিবারের। বুড়ো হোয়াইট আর তাঁর ছেলে হারবার্ট দাবা খেলায় মশগুল, বুড়ী র‍্যাচেল হোয়াইট ব্যস্ত তার সেলাই নিয়ে। ঘরে আগুন জ্বলছে, কেতলিতে জল ফুটছে, হোয়াইট হঠাৎ উৎকর্ণ হয়ে উঠলেন—দরজায় যেন কেউ কড়া নড়ছে, না?

“কই, না—” বলেন হোয়াইট গিন্নী। হারবার্ট একটা ব’ড়ে টিপে দিয়ে বলে উঠল—“কিস্তি”।

হোয়াইট একনজর ছকের দিকে তাকিয়েই টেবিলে এক ঘুষি মারলেন–“আজ আর আসছে না মরিস। আসবে কেমন করে? এ যা রাস্তা হয়েছে আমাদের কহতব্য নয়। এক পশলা জল হল কি না-হল, অমনি কাদায় কাদা। কে আর দেখছে বল!”

হারবার্ট বলে উঠল—“মাৎ”

মাৎ যে, তা হোয়াইটও টের পেয়েছেন, তাই ছকের দিকে আর ভুলক্রমেও তিনি তাকাচ্ছেন না—“আমার নিমন্ত্রণ করে আসাটাই ভুল হয়েছে সেদিন। ভাবা উচিত ছিল যে বর্ষা (বৃষ্টি) হলে বেচারী মরিসের ভোগান্তি হবে। না ট্রেন, না অমনিবাস, না কিছু। স্রেফ চরণমাঝির নৌকো ভরসা। বন্ধু লোকটাকে মেরে ফেলার ফিকির করেছি আমি-”

হোয়াইটগিন্নী বলে উঠলেন—“মিছিমিছি তড়বড় করছ কেন অত? খেলে যাও, পরের বাজি হয়ত জিতবে তুমি—”

হোয়াইট অপ্রস্তুতের একশেষ। এদিক-ওদিক তাকিয়ে শেষকালে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন “হার-জিত নিয়ে কথা হচ্ছে না, আমি ভাবছি আমার বন্ধুর কথা। কুড়ি বছর পরে দেখা। গুদাম সরকারের চাকরি নিয়ে ইণ্ডিয়ায় গেল, ফিরে এল মেজর হয়ে। চিকন-চাকন মুখ, এখন হয়েছে গর্দান ইয়া অল্ডউইচ ষাঁড়ের মত। ভাবলাম-তোমাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া উচিত। আমি কবে আছি কবে নেই, হারবার্টের একটা মুরুব্বী হয়ে থাকে।”

দরজায় কড়া সত্যিই নড়ল। বুড়ো হোয়াইট লাফিয়ে উঠে দুপদুপ করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন বন্ধুর অভ্যর্থনার জন্য।

মিসেস হোয়াইট আয়নার সুমুখে দাঁড়িয়ে চুলটা ঠিক করে নিলেন একবার। হারবার্ট দাবার ছক গুটিয়ে তুলল। হোয়াইট ঘরে ঢুকলেন দশাসই চেহারার একটি প্রৌঢ়কে নিয়ে, মুখখানি তার গোলগাল, রাঙা টকটকে।।

“মেজর মরিস”-পরিচয় করিয়ে দিলেন হোয়াইট করমর্দন, কুশলপ্রশ্ন বিনিময়, চেয়ার গ্রহণ, হুইস্কির গেলাস অতিথির সম্মুখে স্থাপন—-

“তোমার কথাই এতক্ষণ এদের বলছিলাম হে।”-উক্তিটা হোয়াইটের—“বলছিলাম যে মরিসকে দেখলে সাধ জাগে, আমিও একবার ইণ্ডিয়া ঘুরে আসি—-”

হুইস্কির গেলাস মুখ থেকে নামিয়ে মরিস বললেন-“সুখে থাকতে ভূতে কিলায়।”

“কেন? কেন?”—হোয়াইট যেন মর্মাহত হয়ে বলে ওঠেন—“ওকথা কেন বলছ? ইণ্ডিয়ার মত অমন দেশ আর আছে? কতকালের সব পুরনো স্থাপনা! কত সাধুসন্ত ফকির সন্ন্যাসী! কত দড়ির খেলা-দেখানো বাজিকর!”

“কত সাপ! কত প্লেগ! কত ঠগ পিণ্ডারি বোম্বেটে! বলে যাও না! বলে যাও” টিপ্পনী কাটলেন মরিস–

হোয়াইটগিন্নী ততক্ষণে খাবার সাজিয়ে ফেলেছেন টেবিলে। কথাবার্তায় কাজেই একটু মন্দা এসে গেল।।

তারপর হঠাৎ একসময়ে হোয়াইট বলে উঠলেন—“ওহে! সেদিন যে কী-একটা বানরের থাবার কথা বলছিলে–ট্রেন ধরবার জন্য তাড়াতাড়ি চলে এলাম—ব্যাপারখানা খুলে বল দেখি!”

মেজর একটু বিকৃত করলেন মুখটা—“জিনিসটা পকেটেই আছে আমার। সঙ্গে নিয়েই বেড়াই, কারণ ওটা বিক্রি করার চেষ্টাতেই আছি আমি। অবশ্য তোমায় আমি ও-জিনিস বিক্রি করব না কখনো, কারণ তুমি বন্ধুলোক”।

“কেন হে? বন্ধু কি দাম ফাঁকি দেবে, ভাবছ নাকি?”—হাসি এবং বিস্ময়ে মেশামেশি হোয়াইটের কথায়।

“উহু! ফাঁকির কথা নয়, ঝুঁকির কথা। এ-থাবা যে নেবে, সে মস্ত একটা বিপদের ঝুঁকিও নেবে মাথায়। জিনিসটা অভিশপ্ত।”

“অভিশপ্ত?”—হোয়াইট পরিবারের তিনটি প্রাণীই সমস্বরে বিস্ময় প্রকাশ করলেন ঐ একটা শব্দের ভিতর দিয়ে।

“হাঁ, অভিশপ্ত। এক ফকির দিয়ে গেছেন অভিশাপ। মালিকের ক্ষতি ছাড়া উপকার এ কখনো করবে না। অথচ মজা এই-এর অশুভ শক্তির কথা জেনে শুনেও এর মালিক হবার জন্য ক্ষেপে উঠবে সব লোক। কারণ আছে ক্ষেপবার। এ-থাবা মালিকের যে-কোন তিনটি ইচ্ছা পূরণ করতে পারবে। তিনটি মাত্রই অবশ্য, তার বেশী নয়। আর মালিক-পরম্পরায় অনন্তকাল ধরেও নয়। তিনটি মালিক মাত্র ঐ কাজ পাবেন ওর দ্বারায়। পরবর্তী মালিক কেউ যদি আসে, সে পাবে লবডঙ্কা, তৃতীয় মালিকের তৃতীয় ইচ্ছা পূরণের সঙ্গে সঙ্গেই এ জিনিস তার সব শক্তি হারিয়ে ফেলবে।”

কথা বলতে বলতে মরিস পকেট থেকে একটা খাম বার করেছেন—“দেখলেই বুঝতে পারবে যে চেহারা এর যে-কোন মরা বাঁদরের শুকনো কোঁকড়ানো থাবারই মত। অশুভ শক্তির কথা যা বললাম তাও এর নিজস্ব কিছু নয়, সে-শক্তি শয়তানের—”।

হোয়াইট খামটা নিয়ে তা থেকে বার করে ফেলেছেন বানরের থাবাটা। তার হাত থেকে নিল হারবার্ট, কিন্তু মিসেস হোয়াইট ওটা ধরতে গিয়ে হঠাৎ হাত গুটিয়ে নিলেন, মুখে তাঁর ফুটে উঠল অপরিসীম বিতৃষ্ণা।।

হোয়াইট জিজ্ঞাসা করলেন–“তিনজন মালিক, বলছিলে না? কাজ পাবে তিনজন মালিক? তুমি কোন্ মালিক? প্রথম, না দ্বিতীয়, না তৃতীয়?”

“দ্বিতীয়”—চটপট জবাব দেন মরিস।

“প্রথম মালিক-ফকিরের হাত থেকেই তিনি পান ওটা। তার প্রথম দুটো ইচ্ছে কী ছিল, তা আমি জানিনে, তবে তৃতীয় ইচ্ছাটা ছিল মৃত্যু, সেটা আমার হাত দিয়েই তিনি পেয়েছিলেন, এবং কৃতজ্ঞতার বশেই বোধ হয়, মৃত্যুকালে এই বস্তুটা আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন—”

“আর তুমি? তোমার তিনটে ইচ্ছে?”

“আমার তিনটে ইচ্ছেই পূরণ করেছে ঐ থাবা। তবে কী চেয়েছিলাম ওর কাছে, তা আর জিজ্ঞাসা করো না। বলতে ভাল লাগবে না আমার। এখন, ঐ থাবার কাছে আমার আর কোন প্রত্যাশাও নেই, আশঙ্কাও নেই। অকারণ কেন বয়ে বেড়াব? বেচে দেব তাই।”

“তুমি আমাকেই বেচ হে!”–বললেন হোয়াইট।।

“কক্ষণো না’—আগের মতই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মরিস-“বন্ধুর অনিষ্ট আমি কক্ষণো করব না।” একটু থেমে কী যেন ভাবলেন ভদ্রলোক, তার সেই লাল মুখ হঠাৎ যেন রক্তশূন্য দেখাল। নিজের মনেই যেন তিনি বলতে লাগলেন——“বন্ধু বলে হোয়াইটকে আমি দিতে চাইছি না এটা। অন্যকে দিতে আমার আপত্তি নেই। এর মানে যে কী কদর্য, আগে তা ভেবে দেখিনি। না, কাউকেই

আমি দেব না। বন্ধু যারা নয়, তাদেরই বা অনিষ্ট করবার কী অধিকার আছে আমার?”

বলতে বলতেই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের উপরে থাবাটা ফেলে দিলেন মরিস। আর হোয়াইট অমনি ঝাপিয়ে পড়ে আগুনের ভিতর থেকেই ওটা টেনে বার করলেন মরিসের মুখটা এখন দস্তুরমত ফ্যাকাশে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—“ওটা পুড়ে গেলেই ছিল ভাল। যা হোক, আমার সঙ্গে ওর আর সম্বন্ধ নেই কিছু। আগুন থেকে তুমি তুলে নিয়েছ, তুমিই বুঝবে। আমি চলি, ট্রেন ধরতে হলে আর দেরি করা চলে না—-”

“একটা কথা”-হোয়াইট ব্যস্ত হয়ে বললেন—“একটা কথা শুধু। কী ভাবে চাইতে হবে থাবার কাছে? নিয়মকানুন কিছু আছে ওর?”

“না, কিছু না”—মরিস দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বললেন—“শুধু ডান হাতে ওটাকে উঁচু করে ধরবে, তারপর বলবে আমি এই চাই—”।

মরিস বিদায় নিলেন। অনিচ্ছুক বন্ধুর হাতে থাবার মূল্য কিছু জোর করে গুঁজে দিলেন হোয়াইট।

বন্ধুকে এগিয়ে দিয়ে এসে হোয়াইট নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন থাবাটা। হারবার্ট হাসতে হাসতে বলল-“এইবার তাহলে? একটা সাম্রাজ্য চেয়ে নাও থাবার কাছে, কী বল? চাইতেই যদি হয়, ছোট জিনিস কেন চাইব? মারি তো গণ্ডার! কেমন কিনা?” ঠাট্টা থাকুক, কথাটা আগে খেয়াল করা উচিত ছিল”-বললেন হোয়াইট—“বাস্তবিক, আমাদের কী আছে চাইবার? দিব্যি তো আছি আমরা। যা কিছু দরকার সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকতে হলে, সবই তো আমাদের রয়েছে”।

হারবার্ট বলল—“তবে, পেয়েছই যখন জিনিসটা, একটা ছোট্ট জিনিস চাইতে সমস্যা নেই বোধ হয়। পেলে ভালই, না পেলেও এমন কিছু লোকসান নেই। আমি বলছি আমাদের দেনাটার কথা।

বাড়ি তৈরি করতে যে-দেনাটা হয়েছে, তার এখনও দু’শো পাউণ্ড বাকী। শোধ একদিন অবশ্য এমনিই হয়ে যাবে, তবে থাবার দৌলতে যদি চটপট হয়ে যায় তো যাক না। ক্ষতি কী?”

হোয়াইট দোয়ামনাভাবে স্ত্রীর দিকে চাইলেন, তাকেও মনে হল দোয়ামনাই। তখন একটুখানি চুপ করে থেকে তিনি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, আর ডান হাতে বানরের থাবাটা উঁচু করে ধরে

জোরগলায় বললেন-“আমি চাই দুশো পাউণ্ড-”

বলার সঙ্গে সঙ্গেই একটা অস্ফুট চীৎকার করে হোয়াইট বসে পড়লেন আবার-থাবাটা মেজেতে ছিটকে পড়েছে কয়েক ফুট দূরে—

“কী? কী হল? অমন করলে কেন?” ব্যস্ত হয়ে মিসেস হোয়াইট এগিয়ে এলেন।

‘চমকে গেলাম”-কেমন যেন ভয়-ভয় লাগছে হোয়াইটের-‘দুশো পাউণ্ড চাই’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ঐ শুকনো থাবাটা যেন সাপের মত কিলবিল করে উঠল আমার হাতের মধ্যে–”

হারবার্ট হেসে ফেলল—‘স্বাভাবিক, একটা শুকনো খাবার কাছে অত টাকা চাইলে সে কিলবিল করবে না তো কী করবে? যত গাঁজাখুরি—”

‘না, মরিস বাজে কথা বলবার লোক তো নয়!” হোয়াইটের কথায় দৃঢ়প্রত্যয়ের সুর।

“নয়? তাহলে এক্ষুণি শুতে যেয়ো না, ছাদ থেকেই হয়ত ঝনঝন করে দু’শো পাউণ্ড ঝরে পড়বে–”

মুখে যে বলুক, মনে মনে সবাইয়েরই একটা আশা-হয়ত বা পাওয়াই যাবে অর্থটা। মরিস তো বলেছেন যে তিনজন মালিকের তিনটা ইচ্ছাপূরণের ক্ষমতা ও থাবার আছে। তিনি কেন অহেতুক ধাপ্পা দিতে আসবেন একটা পুরোনো বন্ধুকে? এক পেনীও তো দাম তিনি চাননি!

রাত কাটল, সকাল কাটল, প্রত্যাশার রেশ এখনও মিলিয়ে যায়নি হোয়াইট পরিবারের মন থেকে। হারবার্ট চলে গেল তার কারখানায়, যাওয়ার সময়েও বাবাকে ঠাট্টা করে গেল-“টাকাটা বাজে খরচ করে ফেললা না কিন্তু। দেনা শোধ করতে হবে ও দিয়ে”।

সারাদিন উসখুস করছেন বুড়ো-বুড়ী—একটা কিছু হবেই! একটা কিছু হবেই। টাকাটা আসবেই কোনভাবে।

সত্যিই হল একটা কিছু। সাংঘাতিক কিছুই হল। বিকাল তিনটে নাগাদ হারবার্টের কারখানা থেকে এক কর্মচারী এলেন। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে একটা মর্মান্তিক খবর দিলেন তিনি। মেসিনের ভিতর পড়ে গিয়ে হারবার্ট মারা গিয়েছে হঠাৎ।

মিসেস হোয়াইট একটা চীৎকার করে উঠে মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন, আর নিজে হোয়াইট নিস্পন্দ নিঃসাড় হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন আগন্তুকের দিকে।

আগন্তুক মুখ নীচু করেই ছিলেন, সে মুখ আর তুললেন না। মৃদু কিন্তু স্পষ্ট স্বরে বললেন, “কারখানার মালিকেরা এর জন্য কোন দায়িত্ব স্বীকার করেন না। তবে আপনার পুত্র ভাল কর্মী ছিলেন, সেইটি বিবেচনা করে আপনাকে দু’শো পাউণ্ড ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন”

আর বলবার সময় পেলেন না ভদ্রলোক, হোয়াইট সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উপরপানে মুঠি তুলে হাওয়া আঁকড়ে ধরলেন খনিকটা, তারপর কয়েকবার হাঁ করে আর কয়েকবার হাঁ বুজে তিনিও পড়ে গেলেন মেজেতে, তাঁর স্ত্রীর পাশেই। সাত দিন কেটে গেল। একটা দুঃসহ পাষাণভার যেন বুকের উপর চেপে রয়েছে হোয়াইট দম্পতির। বিশেষ করে মিসেস হোয়াইট যেন বাহ্যজ্ঞানরহিত। কখনও নীরবে শুন্যদৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন, কখনও বুক চাপড়ে হাহাকার করছেন হারবার্টের নাম করে করে। হোয়াইটের ভয় হচ্ছে—র‍্যাচেল বুঝি পাগলই হয়ে যাবেন— সে রাত্রে বিছানায় পড়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন বৃদ্ধা, হঠাৎ কী যে হল তাঁর, ধড়মড় করে উঠে বসে স্বামীকে জোরে জোরে নাড়া দিলেন—“শুনছ? ওঠো, ওঠো, বানরের থাবাটা আছে না ঘরে?”

হোয়াইট তো হতভম্ব! আবার বানরের থাবা? উত্তর করলেন–“তা আছে বইকি!”

“এক্ষুণি আনো, – না এক্ষুণি চল। থাবার কাছে হারবার্টকে ফেরত চাও! ফেরত চাও! আমাদের ছেলেকে সে ফিরিয়ে দিক। আমরা যা চাইব, তা তা সে দিতে বাধ্য! চল চল চল—”

বৃদ্ধ স্তম্ভিত। এও কি হয়? দস্তুরমত ক্ষেপে না গেলে কেউ কি এমন অসম্ভব প্রার্থনা করতে পারে? মরা মানুষকে ফিরিয়ে আনতে চাওয়া? জীবিতের সংসারে? এ শুধু পাগলামি নয়, এ পাপও।

কিন্তু তার কোন প্রতিবাদ কানে তোলেন না র‍্যাচেল। সত্যিই তিনি পাগল হয়ে গিয়েছেন। যেন, পাগলের মতই গায়ে এসে গিয়েছে অমানুষিক জোর, ঠেলেই নিয়ে চললেন স্বামীকে নীচের ঘরে। বানরের থাবা সেখানেই আছে।

র‍্যাচেলের উন্মাদনা শেষকালে কি বৃদ্ধ হোয়াইটের মাথায়ও সংক্রমিত হল? চিন্তা করবার ক্ষমতা যেন তিনি হারিয়ে ফেললেন। যন্ত্রচালিতের মত থাবাটা হাতে নিয়ে চেঁচিয়ে বললেন “আমি চাই আমার হারবার্ট বেঁচে ফিরে আসুক”।

সঙ্গে সঙ্গে সেদিনকার মতই থাবাটা লাফিয়ে উঠল, ছিটকে পড়ল গিয়ে দুরে মেঝেতে।

হোয়াইটের সেদিকে লক্ষ্য নেই—তিনি থরথর করে কাঁপছেন-দরজায় মৃদু করাঘাত শোনা গেল না?

র‍্যাচেলও শুনেছেন সে করাঘাত।

“হারবার্ট? হারবার্ট এলি?” বলে তিনি সদর দরজার হুড়কো খুলতে ছুটে গেলেন।

কিন্তু হোয়াইট হঠাৎ প্রকৃতিস্থ হয়েছেন। ঐ করাঘাত? ও কার? হারবার্টের? কী অবস্থায় আসছে হারবার্ট? তাকে নিয়ে কী করবে তার বাপ-মা? প্রেতাত্মাকে ঘরে ঠাই দিতে পারে নাকি কেউ? এ কী করে বসলেন তিনি? র‍্যাচেল ও কী করতে যাচ্ছেন? ওদিকে দরজায় করাঘাত সমানে চলছে। শুরু হয়েছিল মৃদু টোকায়, এখন ধাপে ধাপে উঁচু থেকে আরও উঁচু গ্রামে উঠে গিয়েছে সে-আওয়াজ। এক একটা ধাক্কায় বাড়িটাই কেঁপে কেঁপে উঠছে। দরজা ভেঙে ফেলবে নাকি? র‍্যাচেল হুড়কো খুলেছেন, কিন্তু উপরের ছিটকিনির নাগালে পাচ্ছেন না-

“খুলছি বাবা, খুলছি, দাঁড়া”—ডেকে ডেকে বলছেন র‍্যাচেল। বাইরে থেকে তার জবাব আসছে আরও প্রচৎ ধাক্কায়। যে এসেছে, দরজা ভেঙেই সে ঢুকবে যেন।

হোয়াইট দিশেহারা। কী করবেন? কী করে নিরস্ত করবেন উন্মাদিনী স্ত্রীকে? কী করে আটকাবেন ঐ দুর্ধর্ষ আগন্তুককে? হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি যোগাল। মেঝেতে হাতড়াতে লাগলেন বানরের থাবাটা খুঁজে খুঁজে। র‍্যাচেল একটা চেয়ার টেনে নিয়েছেন দরজার কাছে, ছিটকিনি খুলবার জন্য। দরজা মড়মড় করছে। সেই মুহূর্তে থাবাটা হাতে ঠেকল হোয়াইটের, তিনি উঠে দাঁড়িয়েই একনিশ্বাসে উচ্চারণ করলেন তার তৃতীয় ইচ্ছা। অমনি, সেই মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেল দ্বারের উপর উন্মত্ত আক্রমণ। র‍্যাচেল আজও অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। হোয়াইট ধীরে দরজা খুললেন। বাতির আলোতে স্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে নির্জন রাস্তা, কেউ কোথাও নেই।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments