Tuesday, April 16, 2024
Homeবাণী-কথাসুইসাইড - থ্রিলার স্টোরি

সুইসাইড – থ্রিলার স্টোরি

'সুইসাইড' থ্রিলার স্টোরি

দৌড়াতে দৌড়াতে মি. হাসান রেললাইনের পাশে বেঞ্চটার কাছে এসে থেমে গেলেন। জোরে জোরে বাতাস টেনে শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। প্রতিদিনের মতো আজও জগিং করতে করতে একদম বেঞ্চটার কাছে এসে থামলেন। খুব বিশালদেহী না হলেও চমৎকার ফিট বড়ি তার। আর প্রতিদিন সকালে জগিং করাটা এখন তার কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে শান্ত পরিবেশে জগিং করাটা উনি খুবই উপভোগ করছেন। প্রায় মাসখানেক হলো এখানে বেড়াতে এসেছেন। এলাকাটা খুবই চমৎকার। শান্ত, কোলাহল নেই। ঠিক যেমনটা উনি চেয়েছিলেন। প্রেস, ইলেকট্রনিক মিডিয়া আর পলিটিক্যাল লোকজনের ঝামেলা নেই। বডিগার্ডরা আছে তবে উনি জগিঙের সময় ওদেরকে আসতে মানা করেন। তাই ছুটিটা ভালো লাগছে। তবে এটাকে কতোটা ছুটি বলা যায় সেটাও একটা ব্যাপার। আসলে উনি এই নির্জন পরিবেশে এসেছেন চুপচাপ কিছু জরুরি কাজ সারতে। আগামী মাসে খুবই জরুরি আন্তর্জাতিক একটা মিটিং আছে। সেখানে এমন কিছু জটিল বিষয় পেশ করতে যাচ্ছেন যা অনেকেরই মাথা খারাপ করবে। কাজেই প্রস্তুতিটাও সেভাবেই নিতে হবে।

প্রতিদিনের মতোই বেঞ্চটার কাছে এসে থেমে গেলেন। এখানে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার ফিরে যাবেন। কিন্তু আজ বেঞ্চটাতে এক যুবককে বসে থাকতে দেখে অবাক হলেন খানিকটা। বেঞ্চের একপাশে বসে ক্যান থেকে পানি খেতে খেতে যুবককে খেয়াল করলেন তিনি। বয়স খুব বেশি না, পঁচিশ ছাব্বিশ হবে। একটু লম্বা এলামেলো চুল, ফর্সা সুদর্শন চেহারা। যদিও বেশ মলিন, আর কাপড়চোপড়ও এলোমেলো। খানিক উদাস ভঙ্গিতে বসে আছে।

ব্যাপার কি? হাসান সাহেব মনে মনে ভাবলেন। এই এলাকায় তো সাধারণত কেউ বেড়াতে আসে না। আর এই ছেলেটাকে স্থানীয় বলেও মনে হচ্ছে না। এতে সকালবেলা এখানে কি করছে? হঠাৎ দেখলেন যুবক পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে পড়ছে। পড়তে পড়তে তার চোখ বেয়ে পানি গড়াতে লাগলো।

ছেলেটা কাঁদছে!

“এক্সকিউজ মি? আপনি ঠিক আছেন? কোন সমস্যা?”

চোখ তুলে তাকালো সে। গভীর বিষাদময় দৃষ্টি। কিছু না বলে অন্যদিকে ফিরে তাকালো।

মি. হাসান একটু বিব্রত বোধ করলেন। উঠে যাবেন কিনা ভাবছেন এমন সময় ছেলেটা বললো, “একটু পানি খাওয়া যাবে?”

“কি?” ছেলেটার ভাঙা গলার কারণে হাসান সাহেব কথাটা বুঝতে পারেন। নি।

ছেলেটা পানির ক্যানের দিকে দেখালো। “পানি।”

“হ্যা, শিওর।”

ছেলেটা পানি খেতে নিলে হাসান সাহেব জানতে চাইলেন, “একটা কথা জানতে পারি, আমি এখানে প্রায় মাসখানেক যাবৎ আছি আপনাকে তো এদিকে দেখি নি। তাও এতো সকালবেলা।”

“আমি এখানে থাকি না।”

“ও, একটু আগে দেখলাম কাঁদছেন। কী ব্যাপার? কোন সমস্যা? আমাকে বলতে পারেন।”

“আপনি কে?” বলার ভঙ্গিটা অত্যন্ত কর্কশ।

“আমি হাসান।”

“ইরাজ।”

“নাইস টু মিট ইউ,” বলে হাসান সাহেব হাত বাড়িয়ে দিলেন।

ছেলেটা হাত না ধরে উদাস সুরে জানতে চাইলো, “এখান দিয়ে ট্রেন যাবে কখন বলতে পারেন?”

“সঠিক তো জানি না। তবে আমি জগিং করে ফেরার সময়ে একটা ট্রেন পাস করতে দেখি প্রতিদিন। কেন, আপনি কোথাও যাবেন নাকি?”

“হ্যা।”

“কিন্তু ট্রেন তো এখানে থামে না।”

“আমার তো থামার দরকার নেই।”

“ট্রেন না থামলে যাবেন কিভাবে?”

“কিছু কিছু জায়গা আছে যেখানে যেতে হলে চলন্ত ট্রেন দরকার।”

“মানে, কোথায় যাবেন আপনি?”

“আমি সুইসাইড করবো।”

“কি? আপনার মাথা ঠিক আছে তো?”

ছেলেটা উত্তর না দিয়ে সামনে তাকিয়ে রইলো। মুখে দুঃখের হাসি। “ঠিক আছে দেখেই তো মরতে চাই।”

“তাই, কী এমন হয়েছে যে আপনাকে মরতে হবে।”

“আমি একজন খুনি।”

“আপনি খুনি?”

“হ্যা।”

“ব্যাপারটা কী বিশ্বাস করার মতো?”

“কেন? বিশ্বাস করার মতো না কেন?”

“খুনি কী কখনো নিজে বলে, আমি খুনি?”

“আমি কখনো মিথ্যে বলি না। আপনি বিশ্বাস না করলে কী হবে, আইন তো করে। আমার বাবা-মা তো করে। আমার সব বন্ধুবান্ধবসহ সমাজের সবাই তো করে। আর একারণেই তো আমাকে পালাতে হয়েছে।”

“তা, কাকে খুন করেছেন আপনি?”

“আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে।”

“দেখুন আমি আপনার কেউ না। তবে এটুকু বলতে পারি আপনার সমস্যা যাই হোক না কেন আমি তা সমাধান করার ক্ষমতা রাখি। আপনি আমাকে বলুন তো আসলে ব্যাপারটা কি?”

“আমি আগ্রহী না। কারণ আমার সমাধান করার কোন আগ্রহ সেই। আমি আর…” ট্রেনের হুইসেল শোনা গেলো। ছেলেটা মুখ ফিরিয়ে একবার দেখলো। তারপর উঠে দাড়িয়ে হাসান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি আসলেই আর বাঁচতে চাই না। যার কেউ নেই, কিছু নেই কোন গন্তব্য নেই তার বাঁচার কোন দরকারও নেই। তবে শেষ মুহূর্তে আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। আপনি আমাকে দেখে, পরিচিত হয়ে আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছেন। আর আমার কাছের কেউ গত কয়েক মাসে আমাকে এতোটুকু সাহায্য তো দূরে থাক বিশ্বাসও করে নি আমার কথা। থ্যাঙ্কস।”

ছেলেটা রেললাইনের দিকে এগিয়ে গেলে হাসান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। উনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন ছেলেটাকে মরতে দিবেন না। দরকার হলে জোর খাটিয়ে হলেও ফেরাবেন। উনি পেছন থেকে ছেলেটার কাঁধে হাত রাখলেন।

“দেখো ইরাজ, তুমি আমার ছেলের বয়সিই হবে। সুইসাইড কোন সমাধান না। আমি একজন ক্ষমতাবান মানুষ, আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারবো।”

“সরি,” কাঁধ থেকে হাতটা নামিয়ে ছেলেটা সামনে এগোতে লাগলো। ট্রেনটা কাছাকাছি চলে এসেছে। মি. হাসান ওর একটা হাত ধরে ফেললেন। “দেখো, তুমি ভুল করছে। আমি চোখের সামনে এভাবে একজন মানুষকে মরতে দিতে পারি না।” বলে উনি আরো শক্ত করে হাতটা চেপে ধরলেন। ট্রেনটা আরো কাছে চলে এসেছে।

“কি করছেন আপনি? ছাড়ুন, আমি মরলে আপনার কি? ছাড়ুন।” বলে সে হাতটা ছাড়ানোর জন্যে ধস্তাধস্তি করতে লাগলো। ট্রেনটা প্রায় চলে এসেছে।

ছেলেটা ট্রেন লাইনের প্রায় উপরে চলে যাচ্ছে। ট্রেনটাও প্রায় চলে এসেছে। এভাবে আরেকটু টানাহেঁচড়া চললে দুজনেই এক্সিডেন্ট করবেন। এদিকে ট্রেন ড্রাইভার লাইনের কাছে মানুষ দেখে হুইসেল বাজাচ্ছে।

“আমি তোমাকে ছাড়বো না, ” বলে হাসান সাহেব জোরে একটা টান দিলেন।

“ঠিক আছে,” বলে ছেলেটা একদম শান্ত হয়ে গেলো। “কিন্তু আমাদের একজনকে তো মরতেই হবে।”

“কি?” ভ্যাবাচেকা খেয়ে উনি হাতটা একটু আলগা করে দিতেই ছেলেটা ডান হাত হ্যাঁচকা টানে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রচন্ড শক্তিতে হাসান সাহেবের সোলার প্লেক্সাসে একটা পাঞ্চ করলো। পরমুহূর্তে তার পোলো শার্টের কলার ধরে কোমরে একটা মোচড় দিয়ে করলো হিপ থ্রো। বিস্ময় আর ব্যথায় হতভম্ভ হাসান সাহেব উড়ে গিয়ে পড়লেন ট্রেন লাইনের উপরে, আর তীব্র গতির ট্রেনটা তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে চলে গেলো।

সুদর্শন যুবক বেঞ্চটার কাছে ফিরে এসে হাসান সাহেবের পানির ক্যানটা তুলে নিয়ে এক ঢোক পান করে ক্যানটা ছুড়ে ফেলে দিল একপাশে। হাতের ছাপের ভয় নেই, ফলস লেয়ার লাগানো আছে, একজন প্রফেশনাল কিলার হিসেবে এই ধরনের সতর্কতা তো নিতেই হয়। সে আরেকবার রেললাইনের দিকে ফিরে তাকালো। হাসান সাহেবের মৃত দেহটা দেখলো। তারপর পেছন ফিরে হাঁটতে লাগলো।

কিছুদূর এসে একটা ঝোপের ভেতর থেকে বের করলো তার ব্যাকপ্যাকটা। প্রথমেই মুখের উপর থেকে বয়স কমানোর মেকাপের আলগা আবরন টেনে খুলে নিল, গায়ের শার্টটা খুলে পরে নিলো একটা লেদার জ্যাকেট। শার্ট আর মেকআপ ব্যাগে ভরে ওটা থেকে বের করলো সানগ্লাস আর মোবাইল। সানগ্লাসটা চোখে পরে মোবাইলে ডায়াল করলো একটা বিশেষ নম্বরে।

“হ্যা, কাজ হয়ে গেছে। একমাসের প্ল্যান বৃথা যায় নি। অ্যাম্বেসির ওই কুরিয়ার ছেলেটার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলোও খুব কাজে লেগেছে। আর আমার সাজানো নাটকটাও ঠিক ছিলো। আসলে ওই ছেলেটার তথ্য অনুযায়ীই আমি নাটকটা সাজিয়েছিলাম। ঠিক যেভাবে আপনি বলেছিলেন ‘এক্সিডেন্টাল ডেথ,’ সেভাবেই ঘটেছে মৃত্যুটা। ডিল কমপ্লিট। তো কন্ট্রাক্টের বাকি টাকা আমার একাউন্টে জমা করে দিবেন।”

ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে নিয়ে সে হাইওয়ের দিকে হাটতে লাগলো, গাড়িটা হাইওয়ের পাশেই রাখা। তবে মি. হাসানকে সে মিথ্যে বলে নি। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে ঠিক ওই ধরনের একটা অবস্থায় পড়ে নির্দোষ হয়েও তাকে সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ডের খুনের দায় মাথায় নিতে হয়। কেউ তার কথা বিশ্বাস করে নি। পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে সেদিনও একইভাবে একটা রেললাইনের পাশে বসেছিল, রাস্তা ছিল দুইটা। এক, সুইসাইড আর না হয় প্রটেকশানের জন্যে আন্ডারওয়র্ল্ডে ঢুকে পড়া। প্রথমটার চেয়ে তার কাছে দ্বিতীয়টাই ভালো মনে হয়। তারপর সময়ের সাথে সাথে হয়ে ওঠে, কন্ট্রাক্ট কিলার।

হাঁটতে হাঁটতে অতীত মনে পড়াতে তার মুখে ফুটে উঠলে একটা বাঁকা হাসি…তাতে সামান্য দুঃখ খানিকটা তাচ্ছিল্য…

লেখক: রবিন জামান খান

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments