Friday, March 29, 2024
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পআগন্তুক - হেমেন্দ্রকুমার রায়

আগন্তুক – হেমেন্দ্রকুমার রায়

আগন্তুক - হেমেন্দ্রকুমার রায়

আমাদের গ্রামখানি অনেকটা উপদ্বীপের মত। তার পূর্ব ও উত্তর দিক দিয়ে একটি নদী প্রবাহিত হয়ে পশ্চিম দিকে আর একটি বড় নদীর ভিতর গিয়ে পড়েছে। পৃথিবীর মাটির সঙ্গে আমাদের গ্রামের অবিচ্ছিন্ন যোগ আছে কেবল দক্ষিণ দিকে।

কিন্তু সে যোগটুকু না থাকলেও আমরা হয়তো দুঃখিত হতুম না। আমাদের গ্রামের উত্তর প্রান্তে নদীর কিনারায় যে শ্মশান আছে এ অঞ্চলে তার চেয়ে বড় শ্মশান আর নেই এবং সেই শ্মশানে শবদাহ করবার জন্যে দূর থেকেও লোক আসে ঐ দক্ষিণ দিক দিয়েই। এখানে যে শ্মশানেশ্বর মহাদেব বিরাজ করছেন, তিনি নাকি অত্যন্ত জাগ্রত দেবতা। যদিও তিনি যে নিদ্রাগত না হয়ে অহরহই জাগ্রত হয়ে আছেন এমন কোন প্রমাণই আমরা পাইনি। কিন্তু অধিকাংশ লোক আছেন এখনো সেই কথাই বিশ্বাস করেন, অতএব দেবতার মহিমায় এখানকার শ্মশানটি পরিণত হয়েছে মহাশ্মশানে।

শবযাত্রীদের অস্বাভাবিক ও তীক্ষ্ণ কণ্ঠ থেকে ঘন ঘন হরিবোল ধ্বনি উঠে আমাদের গ্রামের আকাশ-বাতাসকে মুখরিত করে তোলে যখন তখন। দিনের বেলায় সেই সোরগোল কোন রকমে সহ্য করা যায়, কিন্তু নিস্তব্ধ গভীর রাত্রে সে চীৎকার অমানুষিক হয়ে চতুর্দিকে সৃষ্টি করে কেমন একটা অসহনীয় অপার্থিব ভাব। ঘুমন্ত শিশুরা পর্যন্ত ভয় পেয়ে জেগে ককিয়ে কেঁদে ওঠে। গ্রামখানি পুরোপুরি দ্বীপ হ’লে এসব ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হত না।

পল্লীগ্রামের মহাশ্মশানের ভয়াবহতা বীভৎসতা কলকাতার বাসিন্দারা ধারণায়ও আনতে পারবেন না। কলকাতার শ্মশানগুলোকে তো বাহির থেকে দেখায় সৌখিন মানুষদের বসতবাড়ীর মত। এমন কি সেখানে অমাবস্যা রাত্রির অন্ধকার ঘুচিয়ে দেয় বহু ইলেকট্রিকের বাতি।

কিন্তু পল্লীগ্রামের মহাশ্মশান, বড় ভয়ানক ঠাঁই। নিঝুম রাতে সেখানে পদার্পণ করলে সর্বাঙ্গে জাগ্রত হবে বিভীষিকার রোমাঞ্চ। হলুদবরণ চাঁদের পাণ্ডু আলো চারিদিকে প্রকাশ করে অস্পষ্টতার রহস্য এবং তারই সঙ্গে দুটো একটা হ্যারিকেন লণ্ঠন টিম টিম করে জ্বলেও স্পষ্ট করে দেখতে পারে না কোন কিছুই। বাতাসে বাতাসে জেগে ওঠে মরন্ত রোগীর নাভিশ্বাস। আর তাই শুনে চতুর্দিক থেকে কালো কালো দানবের মত মস্ত গাছপালাগুলো শিউরে কেঁদে ওঠে। থেকে থেকে ভেসে আসে সেই আওয়াজ। গাছের ডালে সামান্য পাখির ডাকও তখন প্রেতের হুঙ্কার। এমনকী নিতান্ত শ্মশানযাত্রীরাও চলে বেড়ায় অপচ্ছায়ার মতো। অন্ধকারে চিতার আগুন লকলক করে ওঠে পিশাচের রক্ত–জিহ্বার মতো।

এ–ছাড়া দূরে আনাচে-কানাচে যা-কিছু চোখে পড়ে‚ সব ছায়াছায়ার মত। সেখানে হয়তো আধপোড়া দেহের অংশবিশেষ নিয়ে মারামারি, টানাটানি ছেঁড়াছিঁড়ি করছে শৃগাল-কুকুরের দল। ভেসে আসা তাদের চিৎকারে কেঁপে ওঠে বুক। তারও পরে আরও দূরে যেখানে যেতে নারাজ হয় মানুষের দৃষ্টি, মনে সন্দেহ জাগে, সেখানেও ছায়ার মতো কারা যেন চলাফেরা করে বেড়াচ্ছে। পার্থিব জগতে ঠাই না থাকলেও তারা পৃথিবীর মাটি ত্যাগ করতে রাজি নয়। কখনো অন্ধকার আকাশে ডানা মেলে রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারের মতো উড়ে বেড়ায় বাদুড়ের দল। মনে হয়‚ এখনই হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়বে গলার উপর। অভিধানে শ্মশানের আর এক নাম তাই ‘প্রেতভূমি’। এ নাম মিথ্যা নয়। পল্লীগ্রামের শ্মশান দেখলে প্রেতভূমি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।
এমনি এক শ্মশান থেকে প্রায় সিকি-মাইল দূরে আমরা বাস করি। আমাদের বাড়ী হচ্ছে গ্রামের শেষ বাড়ী। তারপর একটা মাঠ আর ছোট জঙ্গল। তারপরেই নদীর ধারে শ্মশান।
কৃষ্ণপক্ষের কালো রাতের জন্য আসর ছেড়ে মিলিয়ে গেল সন্ধ্যার ঝাপসা আলো।
সেদিন কি বিষম গুমট। বাতাসের দম যেন একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছে, নড়ছে না গাছের একটা পাতা পর্যন্ত। ঘরের ভেতরে টেকা দায়। বাড়ীর বাইরের রোয়াকে এসে বসলুম এবং হাত-পা ছড়িয়ে ভালো করে বসতে না বসতেই শুনলুম বহুকণ্ঠের চীৎকার‚ “বল হরি, হরিবোল! বল হরি, হরিবোল! বল হরি, হরিবোল!”
ঝিল্লিমুখর উত্তপ্ত অন্ধকার রাত্রে এই মৃত্যুধ্বনি মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলল অশান্তি। একটু তফাতে, আমার বাড়ীর সামনে দিয়েই শ্মশানে যাবার রাস্তা। কিন্তু চারিদিকে এত অন্ধকার যে‚ শবযাত্রীদের কারুকেই দেখতে পেলুম না। কেবল শোনা যেতে লাগল হরিনামের সেই শব্দময় বিভীষিকা। ক্রমে তা ক্ষীণতর হয়ে একেবারে থেমে গেল। বুঝলুম শ্মশানে পৌঁছেছে শবযাত্রীরা।
শবযাত্রীদের কণ্ঠ মৌন হল বটে, কিন্তু পল্লীগ্রামের রাত্রের কতকগুলি নিজস্ব ধ্বনি আছে। থেকে থেকে গাছের পাতাদের ফিসফাস, হঠাৎ জেগে ওঠা পাখীদের ডানা ঝাড়া, গাছের তলায় শুকনো পাতাদের ভিতরে সড়সড় শব্দ তুলে হয়তো চলে যায় কোন সাপ বা সরীসৃপ, হয়তো ডেকে ওঠে কর্কশ স্বরে একটা কি দুটো তক্ষক; কিংবা শোনা যায় শৃগালসভার স্বল্পস্থায়ী হট্টগোল; এবং এইসবের উপরেও সর্বক্ষণ জেগে থাকে ঝিঁ-ঝিঁ-ঝিঁ-ঝিঁ করে ঝিঁঝি পোকাদের একটানা আর্তনাদ।

বেশ খানিকক্ষণ একলা বসে শুনলাম সেই রাত্রির ধ্বনি। তারপর চোখের পাতা জড়িয়ে আসতে লাগল তন্দ্রার আমেজে। উঠি উঠি করছি, হঠাৎ যেন অন্ধকার ফুঁড়েই একেবারে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়াল একটা সুদীর্ঘ ছায়ামূর্তি। এমন আচম্বিতে এত নিঃশব্দে তার আবির্ভাব, চমকে না উঠে পারলুম না।
শুধালুম‚ “কে?”
অন্ধকারে মূর্তির চোখদুটো চকচক করে উঠল। সে অত্যন্ত গম্ভীর ও শুষ্কস্বরে বললে‚ “ক্ষুধার্ত অতিথি।”
—“অতিথি! এই রাত্রে!”
—“ক্ষুধার্তের সময় অসময় নেই। কেবল ক্ষুধার্ত নই আমি শীতার্তও। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি। আগে বাড়ীর ভিতরে একটু আশ্রয় দিন বাইরে আর দাঁড়াতে পারছি না।”
মহাবিস্ময়ে বলে উঠলুম, “বলেন কী মশাই আপনার শীত করছে আর এদিকে দারুণ গুমটে সিদ্ধ হয়ে আমরা যেতে বসেছি।”
সে যেন কাঁপতে কাঁপতে বললে, “বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথায় তাহলে এই দেখুন! কই, আপনার হাত কই?”
আমার একখানা হাত বাড়িয়ে দিলুম। সেও হাত বাড়িয়ে ধরলে আমার হাতখানা। কিন্তু, পরমুহূর্তেই আমি শিউরে উঠে তাড়াতাড়ি নিজের হাতখানা টেনে নিলুম। উঃ কি অসম্ভব ঠাণ্ডা তার হাত। ঠিক যেন জমাট বরফ দিয়ে গড়া।
সে কাতরস্বরে বললে, “বাড়ীর ভেতর চলুন, বাড়ীর ভিতরে চলুন! আমি আর বাইরে দাঁড়াতে পারছি না!”
বাড়ীতে ঢুকে ভিতর থেকে সদর দরজাটা বন্ধ করতে যাচ্ছি, হঠাৎ আকাশের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত চিরে ফালাফালা করে দিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে জ্বলে উঠল একটি অতি দীর্ঘ বিদ্যুৎ শিখা। তারপরেই বজ্রের গর্জন! ইতিমধ্যে কখন যে অন্ধকার আকাশ ভরে পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে মেঘের পর মেঘের দল‚ সেটা একেবারেই নজরে আসেনি। বোধহয় বৃষ্টি নামতে দেরি নেই।
বৈঠকখানায় প্রবেশ করে টেবল ল্যাম্পটা উস্কে দিলুম। তারপর কৌতূহলী দৃষ্টি ফেললুম সেই ক্ষুধার্ত অতিথির দিকে।
অদ্ভুত, সবই অদ্ভুত! যেমন ঢ্যাঙা তেমনি রোগা তার দেহ। খালি গা, খালি পা, কোমরে জড়ানো একখানা নতুন কাপড়। দেহের কোথাও যেন মাংস নেই, কেবল চাদর দিয়ে ঢাকা গোটা কতক হাড়! কুচকুচে কালো রং। মাথায় বড় বড় বিশৃঙ্খল চুল। মুখের দুই পাশ চুপসে বসে গিয়েছে। শুকনো ঠোঁট দুখানা ঠেলে দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছে বাইরে‚ যেন মূর্তিমান দুর্ভিক্ষ। আর কী বুভুক্ষু দৃষ্টি!
জানি না, বুকের কাছটা কেন ছমছম করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে শুনলাম বাড়ীর বাইরে ঝড়ের চিৎকার।
থরথর করে কেঁপে উঠে আগন্তুক বললে, “উঃ‚ ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। জানালা বন্ধ করে দিন। জানালা বন্ধ করে দিন!”
জানালাগুলো বন্ধ করে ফিরে দাঁড়িয়ে বললুম, “মহাশয়ের কি কোন ব্যামো–ট্যামো হয়েছিল?”
“ব্যামো? হ্যাঁ হয়েছিল বৈকি! শক্ত ব্যামো। সুবিধে পেয়ে শত্রুরা আমাকে যমের বাড়িতে পাঠাতে চেয়েছিল। তাই তো আমি তাদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে এসেছি।”
‘শত্রু? শত্রু আবার কারা?”

—“জ্ঞাতিশত্রু, মশাই জ্ঞাতিশত্রু। তাছাড়া আবার যমের বাড়ীতে পাঠাতে চাইবে কে?”
—“আপনার কথা আমি ভাল করে বুঝতে পারছি না। তারা কি আপনাকে খুন করতে চেয়েছিল?”
-“বেশী কথা বলবার শক্তি আমার নেই। শুনছেন না‚ ঝড়ের সঙ্গে আবার বৃষ্টি নামল। পৃথিবী এখনি ভাসবে, শীত আরো বাড়বে। আমি শীতার্ত, আমি ক্ষুধার্ত? উঃ, কি খিদে পেয়েছে‚ আমি ক্ষুধার্ত! কিছু খেতে দিন মশাই, আগে কিছু খেতে দিন!”
বললুম, “এত রাত্রে বাড়ীর সকলেরই খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে। তবু চেষ্টা করে দেখছি, একটু অপেক্ষা করুন! কিন্তু বেশী কিছু দিতে পারব বলে মনে হয় না।”
‘যা পারেন তাই দিন। ওঃ শত্রুরা না খাইয়ে মারবে বলে কতদিন আমাকে কিছু খেতে দেয় নি কত দিন আমি উপোষ করে আছি!”
বাড়ীর ভিতরে গিয়ে কোনরকমে সংগ্রহ করলুম কিছু ভাত, কিছু তরকারি, খান–তিনেক রুটি, দুটি সন্দেশ ও চারটি নারকেল নাড়ু। থালার উপরে তাই সাজিয়ে নিয়ে ফিরে গেলুম বৈঠকখানায়। দেখলুম‚ একদিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে অত্যন্ত আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আগন্তুক যেন কান পেতে কি শুনছে। চোখ দেখলে মনে হয়, তার দৃষ্টি যেন ঘরের নিরেট দেওয়াল ভেদ করে চলে গিয়েছে বাইরে, কত দূরে! বললুম, “আপনার খাবার এনেছি।”
কিন্তু সে যেন আমার কথা শুনতেই পেলে না। আচমকা ফিরে দাঁড়িয়ে ত্রস্তস্বরে বলে উঠল, “তারা আসছে, তারা আসছে!”
বিপুল বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলুম, “কারা আসছে?”
—“আমার শত্রুরা! আমি তাদের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, আমি তাদের দেখতে পাচ্ছি। আমি চললুম!”
“—সে কি, আপনার খাবার এনেছি যে?”
‘না, না, আমি আর খাব না, আর আমি ক্ষুধার্ত নই! শত্রুরা আবার আমাকে যমের বাড়ীতে পাঠাবার জন্য ছুটে আসছে! আমি পালাই পালাই।” বলতে বলতে সে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল উদভ্রান্তের মত। তারপরেই দুম্ করে সদর দরজাটা খোলবার শব্দ হল।।

হতভম্বের মত খাবারের থালা হাতে করে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, কে এই আশ্চর্য লোকটা? পাগলাগারদ থেকে পালিয়ে আসেনি তো?
সদর দরজার কপাট দু’খানা ঝোড়ো হাওয়ায় দুমদাম করে একবার বন্ধ হচ্ছে, একবার খুলে যাচ্ছে। তখন পৃথিবীর আর সব শব্দ একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে ঝড়-বৃষ্টির দাপটে!
দরজাটা আবার বন্ধ করে দেবার জন্যে এগিয়ে যাচ্ছি, আচম্বিতে দেখি ছয় সাতজন লোক সবেগে দৌড়ে এসে হুড়মুড় করে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল।
হ্যারিকেন লণ্ঠনটা তুলে সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলুম, “কে?”
তাদের একজন বললে, “আমরা শ্মশান থেকে পালিয়ে আসছি।”
—“পালিয়ে আসছেন? কেন?”
—“এমন দুর্যোগে শ্মশানে কোন মানুষ তিষ্টোতে পারে? ছুটতে ছুটতে এই পর্যন্ত এসে আপনার বাড়ীর আলো দেখে এইখানেই ঢুকে পড়েছি।”
—“তাহলে আপনাদের শবদাহ শেষ হয়েছে।”
—“না মশাই, না। আমাদের কপাল আজ বড়ই মন্দ। শ্মশানে শব রেখে পাশের জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়েছিলুম। কিন্তু ফিরে এসে দেখি, খাটের উপর থেকে মড়া অদৃশ্য হয়েছে। আশ্চর্য ব্যাপার মশাই, আজব কাণ্ড!’’

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments