পাগো-পাগোতে (Pago-Pago) জাহাজ ভিড়ল।। জাহাজটা আসছে সানফ্রানসিস্কো থেকে, যাবে সিডনি পর্যন্ত। এপিয়ার (Apia) যাত্রীদের এখানেই নামতে হবে। তাদের নিয়ে যাবার জন্য স্টিমার একখানা কালই এসে রয়েছে বন্দরে।
অনেক যাত্রীই নামল। এই সামোয়া-অঞ্চলের বাসিন্দাই বেশীর ভাগ, এপিয়ার কয়েকজন মাত্র। অবশ্য এই অল্প কয়েকজন এপিয়ারযাত্রীরই কাহিনী এটা। পাদরী ডেভিডসন (Davidsons), তাঁর স্ত্রী, ডাক্তার ম্যাকফেইল (Macphails), তাঁর স্ত্রী আর—আর মিস টমসন বলে একটি নারী, সে নাকি এপিয়ার কোন্ ব্যবসায়ীর আফিসে ক্যাশিয়ারের চাকরিতে যোগ দিতে যাচ্ছে।
ডেভিডসনদের সঙ্গে ম্যাকফেইলদের আলাপ-পরিচয় এই জাহাজেই হয়েছে। অন্য যাত্রীরা কেউ এঁদের সঙ্গে মিশবার যোগ্য ছিল না বলেই এঁরা পরস্পরের সঙ্গে বেশী বেশী মিশতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাই থেকে গড়ে উঠেছে একধরনের একটু ঘনিষ্ঠতা।
ঘনিষ্ঠতাটি ক্রমে বেড়েই যাবে বলে উভয় পক্ষই আশা করছেন।
ডেভিডসনরা পাদরী, এপিয়াতেই ওঁদের কর্মকেন্দ্র, মাঝে একবছরের ছুটিতে নিজেদের দেশ মার্কিন মুলুকে গিয়েছিলেন। এবার এপিয়াতে পৌছোতে পারলে আর বোধ হয় সারা জীবনেও এখান থেকে পা নাড়া হবেন না।
ডাক্তার ম্যাকফেইল ছিলেন মিলিটারি ডাক্তার। যুদ্ধে একটা গুলি লেগেছিল, তা থেকে সেরে উঠতে পাক্কা দুটি বছর লাগল তার। সেরে ওঠার পরও মিলিটারিতে কাজ করার যোগ্য বলে তিনি বিবেচিত হন নি, এপিয়ার হাসপাতালের ভার দিয়ে তাকে হালকা কাজে নিয়োগ করা হয়েছে।
কাজেই দুটি পরিবার একজায়গাতেই থাকবেন এখন থেকে। মহিলা দু’টি খুব খুশী, সঙ্গীর দরকার ওঁদের যতটা হয়, কর্মব্যস্ত পুরুষদের ততটা হয় না। অবশ্য মিসেস ডেভিডসন নারী হয়েও কাজ করেন কম না, স্বামীর অনুপস্থিতির কালে মিশনটা চালাবার ভার তাঁরই উপর থাকে।
আর অনুপস্থিত তো ডেভিডসনকে থাকতেই হয় মাঝে মাঝে। তার কাজের এলাকা বহুবিস্তীর্ণ। এ-দ্বীপ থেকে ও-দ্বীপে তিনি হামেশাই ছুটছেন ক্ষুদে একখানি ডিঙ্গিতে চড়ে। প্রাণ হাতে করেই যাতায়াত করেন এক এক সময়। একবার মাঝ দরিয়ায় নৌকা ফুটো হয়ে গেল, সারারাত ডেভিডসনকে জল সেচতে হল ওটাকে ভাসিয়ে রাখার জন্য। কর্তব্যের ডাক এলে কোন কষ্টকে কষ্ট বলে উনি মনে করেন না।
বন্দরে নামতেই দুঃসংবাদ কানে এল একটা। যে-স্টিমারে ওঁদের যাওয়ার কথা, সেটা ছাড়ছে না। ওর নাবিকদের ভিতর একজনের নাকি প্লেগ ধরা পড়েছে। গোটা জাহাজটাই তাই কোয়ারানটাইনে আটক। অন্ততঃ দশ দিনের জন্য তো বটেই, সেটা পনেরো দিনও হতে পারে।
এইখানে?
এই পাগো-পাগোতে থাকতে হবে দশ বা পনেরো দিন? যেখানে একটা হোটেল পর্যন্ত নেই? মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন ডেভিডসনেরা আর ম্যাকফেইলরা। কোথায় থাকা যায়? কী খাওয়া যায়? কেমন করে এতগুলো দিন কাটানোই বা যায়?
বন্দরের কাছেই হর্ন কোম্পানির আড়ত। একজন মানুষেরই কোম্পানি, সেই মানুষটিই হল হর্ন! জাতে দো-আঁশলা, আধা-ইংরেজ আধা-সামোয়ান। বাঁধাই কারবারে দু’পয়সা কামিয়েছে। আড়তের বাড়িটা, ছাউনি টিনের হলেও, দোতলা। নীচের তলায় সামনের দিকটাতে দোকান, পিছনদিকটাতে হর্নের বাসস্থান। দোতলাটা সে ভাড়া দেয় ভাড়াটে জুটলে।।
ডেভিডসন-ম্যাকফেইলরা কালবিলম্ব না করে হর্নের কাছে ছুটেছেন। দাঁও পেয়ে হর্ন চড়া দাম হাঁকল। ওঁরা তাতেই রাজী। সারা পাগো-পাগোতে দ্বিতীয় আর একখনা বাড়ি নেই, যেখানে দশ-পনেরো দিন মাথা খুঁজে থাকা যায়। স্থানীয় লোকেদের বাড়িতেও ঘর ভাড়া পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সে-সব ঘর স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার, অস্বাস্থ্যকর।
দুই পরিবার দুখানা শোবার ঘর নিলেন, আর এজমালিতে একখানা বসবার ঘর। আসবাবপত্র অতি সামান্যই আছে ঘরগুলোতে। মিসেস ডেভিডসন মিসেস ম্যাকফেইলকে পরামর্শ দিলেন- “সব কাজ বাদ দিয়ে আগে মশারি মেরামত কর। একটাও যদি ফুটো থাকে তো সারারাত ঘুমাতে পারবে না। সামোয়ার মশা বিশ্ববিখ্যাত, আর তাদের মরসুম এই বর্ষার দিনগুলোই।”
দিনগুলো যে বর্ষার, তা এক মিনিটের জন্যও ভুলে থাকার জো নেই। জাহাজ এসে পাগো-পাগোতে ভিড়বার পরেই বৃষ্টি নেমেছে, সে-বৃষ্টির বেগ ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেড়েই চলেছে যেন। এ-বৃষ্টি এক অদ্ভুত ধরনের বৃষ্টি। ইউরোপে আমেরিকায় যে ধরনের বৃষ্টি পড়ে, তার সঙ্গে এর গরমিল অনেক। সে-বৃষ্টি হালকা, নরম, এ-বৃষ্টি গুরুভার, হিংস্র। টিনের চালের উপরে এ-বৃষ্টি পড়ছে—ধারায় নয়, প্রপাতে। ঘরবাড়ি ভেঙে চুরে ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়ার জন্যই যেন এর পণ (ইচ্ছা)।
খাঁটি সাহেব বলতে পাগো-পাগোতে একজনই আছেন। তিনি আর কেউ নন, খোদ গভর্নর। একমাত্র শ্বেতাঙ্গ বাসিন্দা বলেও বটে, আবার শাসনকর্তা বলেও বটে, ডেভিডসন আর ম্যাকফেইল। কার্ড রেখে এসেছেন গভর্নরের বাড়িতে। অন্য কোথাও যাওয়ার দরকারও ছিল না, উপায়ও ছিল না একঘেয়ে বৃষ্টির জন্য। কাল যদি বৃষ্টি থামে, ডেভিডসন অন্ততঃ বেরুবেন একবার। গভর্নরের সঙ্গে আলাপ করাটা দরকার তার। তার ধর্মের প্রচার কী রকম হচ্ছে এখানে, খোঁজখবর নিতে হবে বইকি! ওটা তার কর্তব্যের মধ্যে।
সন্ধ্যাবেলা উভয় দম্পতি বসবার ঘরে সমবেত হয়েছেন। ডিনার এখানে বেলা একটাতেই। পাঁচটার সময়ও কিছু খাবার পাঠায় হর্ন, চায়ের সঙ্গে কিছু রুটি আর কিছু মিষ্টি। এটার নাম হল “হাই-টী”। এর পরে আর খাওয়া-দাওয়ার কোন পাট নেই। বিস্কুট রাখো নিজের ঘরে, ক্ষিধে পেলে চিবিয়ে খাও। হাই-টী আস্বাদনে যখন এরা ব্যস্ত, হঠাৎ নীচে থেকে একটা গানের আওয়াজ এলো। মরেছে! এ-বাড়িতে গ্রামোফোন আছে নাকি? হর্নকে নিষেধ করে দিতে হবে তো! নিষেধ করার মতলবটা মিসেস ডেভিডসনের মাথাতেই খেলেছে। তারা পাদরী, সবরকম দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপোসহীন জেহাদ ঘোষণাই তাদের কাজ। আর ঐ গ্রামোফান! যন্ত্র হিসাবে ওটা দুর্নীতিমূলক হতে পারে, কিন্তু কী-সব রেকর্ড ওতে চাপানো হচ্ছে, শোনো না একবার! অভব্য, অশালীন, অশ্লীলই বলা যায়।
ম্যাকফেইল বললেন-“হর্নকে বলতে চান, বলতে পারেন, বাড়িওয়ালা যখন সেই। কিন্তু গ্রামোফোনটা তার নয়। আমাদের জাহাজেই এক যাত্রিণী ছিল, সেও এই বাড়িতেই এসে উঠেছে। যন্ত্রটা তারই। সে যখন এলো, ওটা তার সঙ্গেই দেখেছি। আমি তখন নীচেই ছিলাম”
“তবু বাচলাম যে উপরে তাকে তোলে নি হর্ন”—বললেন মিসেস ম্যাকফেইল।
“এক ডলারের বেশী দৈনিক দিতে পারত যদি মেয়েটি, হর্ন কী করত বলা যায় না। সিঁড়ির নীচে একটা ঘোট ঘর মালপত্রে ঠাসা ছিল, সেই ঘরটাই খালি করে দিয়েছে ওর জন্যে—”
গ্রামোফোনে একটা নাচের রেকর্ড চেপেছে ততক্ষণ। আর সেই রেকর্ডের সুরের তালে তালে ধাপরধাঁই নাচ শুরু করেছে কয়েকটা লোক।
“ও ঘরের ভাড়াটে বন্ধুবান্ধব যোগাড় করে ফেলেছে দেখছি”–মন্তব্য করলেন ম্যাকফেইল।
পাদরী ডেভিডসনের মুখ ক্রমশঃ লাল হয়ে উঠছে।
“এ তো চলতে পারে না।”—বলেই তিনি আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, আর অন্য কেউ কোন কথা বলবার আগে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। সিঁড়ি দিয়ে দুমদুম করে নামছেন তিনি, টের পাওয়া গেল।
ম্যাকফেইল উদ্বিগ্নভাবে বললেন-“উনি কি নীচে যাচ্ছেন? ওরা তো বর্বর সব, ওদের সামনে এ সময়ে যাওয়া কি ঠিক হবে?”
মিসেস ডেভিডসন উত্তর দিলেন–“আপনারা ওঁকে চেনেন না। যার হৃদয় পবিত্র সে কোন কিছুতে ভয় পায় না। ধর্মের বর্মে উনি অভেদ্য—-”
এ-কথার উপরে আর কথা কওয়া চলে কেমন করে ম্যাকফেইল তা বুঝে উঠতে পারলেন না। ইতিমধ্যে নীচে শোরগোল শুরু হয়ে গিয়েছে। ডেভিডসন শাসাচ্ছেন, অন্যেরা টিটকারি দিচ্ছে। গ্রামোফোনটা উলটে ফেললেন ডেভিডসন, শব্দ পাওয়া গেল উপরে বসেই। তারপরেই একটা ধস্তাধস্তির শব্দ—-
ম্যাকফেইল নীচে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছেন, এমন সময়ে ডেভিডসনই উপরে উঠে এলেন। তিনি বসবার ঘরে আর এলেন না, সোজা চলে গেলেন শোবার ঘরে। তার স্ত্রীও উঠে গেলেন তার অবস্থা দেখবার জন্য। পরের দিন শোনা গেল ঘটনা। মিসেস ডেভিডসনের মুখেই শোনা গেল। ওরা এক গেলাস মদ ছুড়ে মেরেছে ডেভিডসনের গায়ে, জামাটা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ভোরে উঠেই ডেভিডসন বেরিয়ে গিয়েছেন। গিয়েছেন গভর্নরের কাছে। সব কথা বলেছেন তাকে। ডেভিডসন ফিরলেন ডিনারের পরে। গভর্নর তাঁকে না খাইয়ে ছাড়েন নি। খাতির করেছেন খুব। হর্নের কাছে আরদালী পাঠিয়েছেন তাকে সতর্ক করে দিয়ে।
তবে এতে ডেভিডসন খুশী নন। তিনি চান মিস টমসনকে প্রথম স্টিমারেই সানফ্রানসিস্কোতে ফেরত পাঠানো হোক। এপিয়াতে ও আপদকে তিনি যেতে দেবেন না।
গভর্নর আবার অতটা জবরদস্তি করতে ইচ্ছুক নন। মেয়েটা যদি আমেরিকায় গিয়ে এ নিয়ে হইচই করে, খবরের কাগজে লেখালেখি হয় এ সম্বন্ধে, গভর্নর বেশ বেকায়দায় পড়ে যাবেন। আইনভঙ্গ করলে তার জন্য ন্যায্য সাজা দেওয়া যায়, কিন্তু অশ্লীল রেকর্ড বাজাবার অপরাধে কাউকে জোর করে দ্বীপান্তরে পাঠানো যায় না।
কিন্তু ডেভিডসন নাছোড়বান্দা। তিনি ক্রমাগত জপাচ্ছেন গভর্নরকে। বৃষ্টিটাও একমুহূর্তের জন্য থামছে না। মনমেজাজ সকলেরই তিক্ত। স্টিমারখানা কবে কোয়ারানটাইন থেকে মুক্তি পাবে, সবাই তারই জন্য দিন গুনছে। এখান থেকে বেরুতে পারলে বাঁচা যায় যে! মিস টমসন-ঘটিত ব্যাপারটার দরুন পাগো-পাগোর হাওয়াটাই যেন বিষিয়ে উঠেছে।
হর্ন সতর্ক হয়ে গিয়েছে, গভর্নরের আরদালী আসার পর থেকেই। মিস টমসনকে সে কড়কে দিয়েছে—বাইরের লোক নিয়ে এসে নরক গুলজার করা চলবে না তার বাড়িতে, এমন কি ঐ ছাই গ্রামোফোন বাজানোও চলবে না। বাধ্য হয়ে সংযত হয়েছে মেয়েটা। নাচগান বন্ধ করেছে। কিন্তু মেজাজ দেখাতে ছাড়ে না। ছোট জায়গা, পথেঘাটে দেখা হয়ই। দেখা হলেই এমন
ভঙ্গী করে পাশ দিয়ে চলে যায় ডেভিডসনদের যে তাদের গা জ্বালা করে।
অবশেষে ডেভিডসন ভয় দেখাতে শুরু করলেন গভর্নরকে “জানেন, আমাদের মিশনের কত প্রতিপত্তি ওয়াশিংটনে? আপনার নামে মিশন যদি কলোনি সেক্রেটারির কাছে রিপোর্ট করে, ত তাতে ক্ষতি হবে না, ভেবেছেন? আপনি খ্রীষ্টধর্মের অবমাননা দেখেও নির্বিকার থাকেন যদি, এ নিয়ে কি রিপোর্ট করা যায় না, বলতে চান?”
ক্ষুদ্র জায়গা পাগো-পাগো, তার গভর্নর এমন কিছু জাঁদরেল অফিসার নয়। রিপোর্টের নামে তিনি কুঁকড়ে কেঁচো হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে হুকুম পাঠালেন মিস টমসনকে—পরের স্টিমারেই তাকে সানফ্রান্সিস্কোতে ফিরতে হবে। পাঁচ দিন সময়।
এইবার মিস টমসন শায়েস্তা হল। ফিরে যেতে সে নারাজ। এপিয়াতে যেতে তাকে হবেই, সেখানে তার চাকরি ঠিক হয়ে আছে। হুকুমটা যাতে রদ হয়, এই প্রার্থনা নিয়ে সে ধরনা দিল গবর্নমেন্ট হাউসে। গভর্নর বলে দিলেন-রেভারেণ্ড ডেভিডসন যদি রাজী হন, তিনি হুকুমটা রদ করে দেবেন।
মিস টমসন সব দেমাক জলাঞ্জলি দিয়ে এবার এসে কেঁদে পড়ল পাদরী ডেভিডসনের কাছে “আমায় ক্ষমা করুন। আমি এবার থেকে ভাল হয়ে চলব, শুধরে নেব নিজেকে।”
মিসেস ডেভিডসন বিজয়িনীর দৃষ্টি হেনে মিসেস ম্যাকফেইলকে বললেন-“দেখলে বোন? আমার স্বামীর ক্ষমতাটা দেখলে ত?”
ডেভিডসন ওদিকে মিস টমসনকে বলছেন—“শুধরে যদি তুমি সত্যিই নাও নিজেকে, আমি সবই ক্ষমা করতে রাজী আছি। পাদরীর তো কাজই ঐটা। পাপীকে উদ্ধার করা। তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে সাহায্য করব ধর্মপথে চলতে।”
মেয়েটার তখন একমাত্র লক্ষ্য কিসে পাদরীটাকে খুশী করা যায়, সে বিনীত হয়ে বলল “আমি ধর্মপথে চলতেই চাই, কী করে চলব–আপনি উপদেশ দিন।”
“বেশ, বাইবেল পড়।”
“আমি তো ভাল পড়তে পারি না। পড়তে যদি-বা পারি, বুঝতে পারব না কিছুই। আপনি যদি দয়া করে বুঝিয়ে দেন—”
“বিলক্ষণ! দয়াটয়া নয়, পাদরীর তো কর্তব্যই এই। আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেব প্রভুর বাণী—”
তার পর থেকে নিত্যনিয়মিত বাইবেলের ক্লাস বসতে লাগল মিস টমসনের ঘরে। সানফ্রানসিস্কোর স্টিমার এল এবং চলেও গেল। এইবার মিস টমসন ঝেড়ে ফেলতে পারত ডেভিডসনকে, কিন্তু, কী আশ্চর্য, তার মন বসে গিয়েছে ধর্মকথায়, পাথর ফেটে দরিয়া ছুটেছে, অনাচার-পাপাচারের উপর আসক্তি ধুয়ে গিয়েছে সেই দরিয়ার তরঙ্গে।।
এদিকে যত-না তার পড়ার আগ্রহ, তত আগ্রহ ডেভিডসনেরও পড়াবার জন্য। সকালে পড়াতে বসেন, ডিনার পর্যন্ত পড়িয়ে যান। হাই-টীর পরে আবার বসেন, রাত দুপুর হয়ে যায় পড়াতে পড়াতে। মিসেস ডেভিডসন বিজয়িনীর দৃষ্টি হানেন মিসেস ম্যাকফেইলের পানে–“স্বামী আমার ধর্মবীর, বিখ্যাত সাধু সেন্ট পিটার, সেন্ট পলের সগোত্র।”
সেদিন শেষ রাতে হর্ন এসে দরোজায় ধাক্কা দিল ডাক্তার ম্যাকফেইলের। আশ্চর্য হয়ে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে——“কী ব্যাপার?”
হর্ন নিম্নস্বরে যা বলল, তা শুনে ম্যাকফেইল যেন পাথর বনে গেলেন একেবারে।
সমুদ্রের ধারে রেভারেণ্ড ডেভিডসনের মৃতদেহ পড়ে আছে। গলাটার আধাআধি ক্ষুর দিয়ে কাটা! ক্ষুর এখনও ডেভিডসনের হাতেই ধরা আছে।
পুলিস নিয়ে গভর্নর স্বয়ং এলেন। মিস টমসন বলল—পাদরী রাত বারোটা নাগাদ উপরে উঠে গিয়েছিলেন। তার পরে সে আর তাকে দেখে নি। মিসেস ডেভিডসন বললেন–রাত বারোটা নাগাদ তার স্বামী উপরে উঠে এসেছিলেন, তা ঠিক। তার পরে তিনি আবার বেরিয়ে গেলেন, এই পর্যন্তই মিসেস ডেভিডসন জানেন। কোথায় গেলেন, কী হল তার, তিনি তা জানেন না।
ডাক্তার ম্যাকফেইল নিস্তব্ধ। তিনি কি এ-ব্যাপারের বুঝলেন কিছু?
কোয়ারানটাইন-মুক্ত স্টিমার যখন এপিয়াতে যাত্রা করল শেষ পর্যন্ত, তাতে না গেলেন মিসেস ডেভিডসন, না গেল মিস টমসন। ম্যাকফেইলরা যেতে বাধ্য, কারণ ডাক্তারের চাকরি সেখানে।
মিসেস ডেভিডসন নিজের দেশে ফিরলেন, আর মিস টমসন গিয়ে ঢুকল এক সন্ন্যাসিনীর মঠে। পাদরী কেন যে আত্মহত্যা করলেন সে সম্বন্ধে তার কোন অনুমানও নেই। সে শুধু এইটুকু জানে যে ডেভিডসনের বেশে কোন দেবদূত এসেছিলেন তাকে পাপের পঙ্ক থেকে উদ্ধার করতে।