Friday, April 26, 2024
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পরাত-বিরেতে - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

রাত-বিরেতে – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

রাত-বিরেতে - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

মুরারিবাবু খুব বিপদে পড়েছেন! রাতদুপুরে বাড়ির উঠোনে টুপ-টুপ করে ঢিল পড়ে। কারা ছাদে হেঁটে বেড়ায় ধুপধুপ, ধুপ-ধুপ। বেরিয়ে কিন্তু কাউকে দেখতে পান না। টর্চ জ্বেলে বাড়ির চারপাশটা বৃথা খোঁজাখুঁজি করেন। নিরিবিলি জায়গায় বাড়িটা। পাড়ার মধ্যেও নয় যে ছেলেরা দুষ্টুমি করবে। তা ছাড়া, তাজ্জব ব্যাপার, ঢিল পড়ার শব্দ পান এবং দু-একটা তার টাকেও পড়ে, অথচ ঢিল দেখতে পান না।

তাহলে? এ নিশ্চয় অশরীরীদের কাজ। মুরারিবাবুর বন্ধু ফৈজুদ্দিন এ শহরের নামকরা উকিল। তিনি এসে সব শুনে বললেন, দেখ মুরারি! আমার মনে হচ্ছে, তুমি জিনের পাল্লায় পড়েছ।

মুরারিবাবু বললেন,–জিন? সে আবার কী? সবাই তো বলছে, ভূতেরই কাণ্ড।

–উঁহু। ভূত থাকে বনবাদাড়ে, জলার ধারে, নিরিবিলি জায়গায়। পারতপক্ষে তারা মানুষের কাছে ঘেঁষে না। কারণ, মানুষ মরেই তো ভূত হয়। বেঁচে থাকার ঝক্কি কতটা, মানুষ মরার আগে হাড়ে-হাড়ে জানে। ঘেন্না ধরে যায় মনুষ্যজীবনে। কাজেই মরে ভূত হওয়ার পর কোন পাগল আর মনুষ্যজীবনের আনাচে-কানাচে আসতে চাইবে বলো।

মুরারিবাবুর মনে ধরল কথাটা। ফৈজুদ্দিন-উকিলের যুক্তির পাঁচে কত বাঘা বাঘা হাকিম হার মানে। মুরারিবাবু বললেন, হুঁ, তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু জিন কী?

ফৈজুদ্দিন খুশি হয়ে বললেন,–জিনদের ব্যাপারস্যাপার অবিকল ভূতদেরই মতো। তবে তারা একরকম প্রাণী বলতে পারো। তারা মানুষের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়। এঁটোকাটা, আবর্জনা, গোবর, হাড় এইসব নোংরা জিনিস তাদের খাদ্য। ইচ্ছে করলেই তারা অদৃশ্য হতে পারে। আবার ইচ্ছে করলেই নানারকম রূপ ধরতে পারে!

–তারা থাকে কোথায়?

পোড়াবাড়িতে। চিলেকোঠায়। ছাদে। কখনও বাথরুমের ঘুলঘুলিতে। –ফৈজুদ্দিন চাপা গলায় বললেন! আমার বাথরুমের ঘুলঘুলিতে একটা জিন ছিল। বুঝলে? রোজ চান করতে ঢুকতুম, আর ব্যাটা মুখ বাড়িয়ে আমায় ভেংচি কাটত। দুটো জুলজুলে নীল চোখ। বাপ! এখনও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

মুরারি আঁতকে উঠে বললেন,–দেখতে কেমন জিনটা! খুব ভয়ঙ্কর চেহারা নিশ্চয়?

তত কিছু না, ফৈজদ্দিন কড়ে আঙুল দেখালেন!–এইটুকুন। একটা টিকটিকির মতো বিদঘুঁটে।

–তারপর? তারপর? কীভাবে সেটা তাড়ালে?

–কালা-ফরিককে ডেকে আনলুম, সে ব্যাটাকে আতরের শিশিতে পুরে পুকুরে ফেলে দিয়ে এল। তুমি কালাফকিরের কেরামতি তো জানো না! তাকে দেখলে জিনেরা লেজ ফেলে রেখে পালায়!

মুরারির একটু খটকা লাগল। বললেন,–পালায় যদি শিশিতে পোরে কীভাবে?

ফৈজুদ্দিন ফাঁচ্ করে হাসলেন।–সেটাই তো কালা-ফকিরের কেরামতি, তুমি এক্ষুনি ওর কাছে যাও। দেখবে ফকিরসাহেব এসে তোমার বাড়ির জিনগুলোকে বস্তায় পুরে সমুদুরে ফেলে দিয়ে আসবে।

মুরারি লাফিয়ে উঠলেন। কিন্তু ফের খটকা লাগল মনে। বললেন, বস্তা কেন? ওই যে বললে আতরের শিশির কথা?

–বুঝলে না? তোমার বাড়ির জিন তো ঘুলঘুলির খুদে জিন নয়। একটা দুটোও নয়–একেবারে একগাদা। তা ছাড়া, তারা ভেংচি কাটে না, ঢিল ছোড়ে। ছাদ কাঁপয়ে হেঁটে বেড়ায়। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, তাদের সাইজ বড়। যাকগে, আদালতে যাওয়ার সময় হল। তুমি এক্ষুনি কালা-ফকিরের কাছে যাও।

ফৈজুদ্দিন ব্যস্তভাবে চলে গেলেন। একটু পরে মুরারিবাবুও বেরিয়ে পড়লেন। কালা-ফকির থাকে শহরের বাইরে এক নির্জন দরগায়। নিঝুম জায়গা। কোনও পিরসাহেবের কবর আছে। ফকির সেই কবরে আগরবাতি আর সজবাতি জ্বালে। কদাচিৎ ভক্তরা এসে সিন্নি আর দশ-বিশ পয়সা মানত দিয়ে যায়।

মুরারিবাবুকে দেখে কালা-ফকির চোখ পাকিয়ে বলল, কী? জিনের পাল্লায় পড়েছ বুঝি? ভাগো, এখন আমার যাওয়ার সময় নেই।

কালো আলখেল্লাপরা পাগলাটে চেহারার ফকিরকে দেখে মুরারিবাবু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তার ওপর এই কড়া ধমক। কিন্তু উপায় নেই। খুব ভক্তি দেখিয়ে একটা টাকা ফকিরের পায়ের কাছে রেখে বিনীতভাবে বললেন, দয়া করে একবার যেতেই হবে বাবা। রাতে ওদের অত্যাচারে ঘুম হয় না। বড় বিপদে পড়ে এসেছি আপনার কাছে।

ফকির টাকাটা ভালো করে দেখে নিয়ে আলখাল্লার ভেতরে চালান করে দিল। তারপর বলল, ঠিক আছে। বাড়ি গিয়ে একটা বস্তা জোগাড় করে রাখো। সব নিশুতি হলে রেতের বেলা যাবখন।

কালা-ফকির সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত করে এল। বস্তাটা ভালো করে দেখে নিল ফুটো আছে নাকি। তারপর সেটা নিয়ে একটা অষ্টাবক্র লাঠি নাচাতে নাচাতে সে অন্ধকার বাড়ির চারদিকে চক্কর দিতে থাকল। বিড়বিড় করে কী সব আওড়াচ্ছিল। এদিকে মুরারিবাবু, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সে ঘরের ভেতর থাকতে বলেছে। খবরদার, কেউ যেন না বেরোয়। বেরুলে বিপদ।

কতক্ষণ পরে ফকির চেঁচিয়ে ডাকল,-বেরিয়ে এসো সব। কেল্লা ফতে। সবকো পাকাড় লিয়া।

সবাই বেরিয়ে গিয়ে দেখল, কালা-ফকির বস্তার মুখটা দড়ি দিয়ে বেঁধে তার ওপর সেই বাঁকাচোরা লাঠিটা দমাদ্দম চালাচ্ছে। বল! আর জ্বালাবি বল, কখনও ঢিল ছুড়বি?

মুরারিবাবুর স্ত্রী নরম মনের মানুষ! কাঁদকদ মুখে বললেন,–ওগো! ফকিরসায়েবকে বারণ করো! আহা অত করে বেচারাদের মারে না! মরে যাবে যে!

ফকির একগাল হেসে বলল, ঠিক আছে। মাঠাকরুন বলছে যখন। তোকই রাহাখরচ দাও! সমুদুরে ফেলতে যাব। সমুদ্র কি এখানে? তেরো নদীর পারে। ট্রেনে বাসে জাহাজে কতবার চাপতে হবে, তবে না।

রাহাখরচ নিয়ে ফকির চলে গেল। বস্তা কাঁধে নিয়েই গেল। মুরারিবাবুর বড় মেয়ে বিলু চোখ বড় করে বলল,-বাবা, বাবা! বস্তার ভেতর কেমন একটা শব্দ হচ্ছিল শুনেছ।

তার মা বললেন, চুপ, চুপ। বলতে নেই।

আজ সবাই নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে। খাওয়া-দাওয়া সেরে নিথে আরও রাত হল। বাড়ি নিরাপদ। তাই উঠোনে মুরারিবাবু মহানন্দে পায়চারি করতে থাকলেন। গল্পগুজবও করলেন নানারকম। সব নিশুতি নিঝুম হয়ে গেছে। ঝিঁঝি ডাকছে। জোনাকি জ্বলছে গাছপালায়। সেই সময় রাত বারোটা পাঁচের ডাউন ট্রেন শিস দিতে-দিতে আসছ। রেল লাইন বাড়ির ওপাশ দিয়ে গেছে। বাড়ি থেকে উঁচুতে রেললাইন। ট্রেন গেলে উঠোন থেকেও দেখা যায়। ট্রেনের আলো ঝলসে দিয়ে যায় বাড়িটাকে। বিলুর ভাই অমু বলল, বাবা, ফকির এই ট্রেনেই যাচ্ছে।

মুরারিবাবু বললেন, হ্যাঁ। বে অফ বেঙ্গল যেতে হলে…

হঠাৎ তার কথা থেমে গেল। লাফিয়ে উঠলেন। এ কী? ফের তার মাথায় ঢিল পড়ল যে? শুধু তাই নয়, কালোকালো আরও ঢিল উঠোনে তাঁর আশেপাশে টুপ-টুপ করে পড়ছে। ট্রেনের আলোটা সোজা এসে পড়ছে তাঁর গায়ে। মুরারিবাবু আতঙ্কে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। মুখে কথা নেই। ট্রেন চলে গেলে ঝলসানো আলোটাও সরল। তখন মুরারির মুখে কথা এল। ঘরে ঢোক! ঘরে ঢোক! বলে উঠোন থেকে বারান্দায় উঠলেন।

তারপর রাগে দুঃখে আতঙ্কে অস্থির হয়ে বললেন, ব্যাটা ভণ্ড ফকির স্রেফ ঠকিয়ে গেল। ওঃ কী ভুল না করেছি!

বিলুর মা বললেন,–সে কী। কেন, কেন, ওকথা বলছ?

এইমাত্র ঢিল পড়ল দেখলে না? আমার মাথাতেও পড়ল।–মুরারি টাকে হাত বুলোতে বুলোতে গিয়ে ফের লাফিয়ে উঠলেন। ওরে বাবা। আমার কানের পাশে কী যেন রয়েছে। ঢিল! ভূতুড়ে ঢিল আটকে রয়েছে।

অমু বাবার কানের পাশ থেকে কালো কী একটা খপ করে ধরে ফেলল। তারপর বলল,-ও বাবা। এটা তো চামচিকে!

অ্যাঁ।–মুরারি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। অমু চামচিকেটা ছেড়ে দিতেই থামের গায়ে আটকে গেল। কিন্তু বলা যায় না, জিনেরা কতরকম রূপ ধরে! তাই তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন,–মার-মার! জুতোপেটা কর।

সেই সময় অমু বলে উঠল, বাবা, ইউরেকা!

–ইউরেকা মানে?

অমু রহস্যভেদী গোয়েন্দার মতো ভারিক্কি চালে বলল, মাত্র চামচিকে। স্রেফ চামচিকে বাবা! বুঝলে না? ট্রেনের আলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে উড়ন্ত চামচিকেগুলোর চোখ ধাঁধিয়ে যায় আর টুপ টুপ করে পড়তে থাকে। আমরা ভাবি ঢিল পড়েছে।

মুরারিবাবু সন্দিগ্ধভাবে বললেন, কিন্তু ছাদের ধুপধাপ শব্দ?

অমু তেমনি গম্ভীর হয়ে বলল, শব্দ হোক না, আমি ছাদে যাব।

তার মা বললেন, ওরে না-না। যাসনে অমু! ওই শোন কারা হেঁটে বেড়াচ্ছে। ওগো কাল বরং ওঝা ডেকে আনো। মনে হচ্ছে, ওরা জিনটিন নয়, অন্য কিছু।

মুরারি সায় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ। ভূতই বটে। কালই হরিপদ ওঝার বাড়ি যাব।

ওদিকে তক্ষুনি অমু ছাদে চলে গেছে টর্চ নিয়ে। ছাদ থেকে তার গলা শোনা গেল। বাবা-মা। ইউরেকা, এগেন ইউরেকা!

এবার সবাই উঠোনে নামলেন ভয়ে-ভয়ে! কী দস্যি ছেলেরে বাবা! মুরারি বললেন, কী রে?

–ছুঁচো বাবা!

–আঁ!

–হ্যাঁ বাবা! আর কিছু না–স্রেফ ছুঁচো ডন টেনে বেড়াচ্ছে। দেখবে এসো।

মুরারি নিশ্বাস ফেলে বললেন,–। নেমে আয়।

ছাদে রাজ্যের আবর্জনা জমে আছে। পুরোনো বাড়ি। ছুঁচোর আজ্ঞা হতেই পারে। রাতবিরেতে একদঙ্গল ছুঁচো ছাদে ডন টানে। গানও গায় নেচে-নেচে। তাই শব্দ হয়। বাড়িটা এবার মেরামত করে কলি ফেরানো দরকার। চামচিকে, ছুঁচো, ইঁদুর, আরশোলা টিকটিকির আড্ডা হয়ে গেছে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments