Thursday, April 18, 2024
Homeরম্য গল্পপেটুক - সুকুমার রায়

পেটুক – সুকুমার রায়

sukumar roy book

“হরিপদ! ও হরিপদ!”

হরিপদর আর সাড়াই নেই! সবাই মিলে এত চ্যাঁচাচ্ছে, হরিপদ আর সাড়াই দেয় না। কেন, হরিপদ কালা নাকি? কানে কম শোনে বুঝি? না, কম শুনবে কেন—বেশ দিব্যি পরিষ্কার শুনতে পায়। তবে হরিপদ কি বাড়ি নেই? তা কেন? হরিপদর মুখ ভরা ক্ষীরের লাডু, ফেলতেও পারে না, গিলতেও পারে না। কথা বলবে কি করে? আবার ডাক শুনে ছুটে আসতেও পারে না—তাহলে যে ধরা পড়ে যাবে। তাই সে তাড়াতাড়ি লাড়ু গিলছে আর জল খাচ্ছে, আর যতই গিলতে চাচ্ছে ততই গলার মধ্যে লাড়ুগুলো আঠার মতো আটকে যাচ্ছে। বিষম খাবার যোগাড় আর কি!

এটা কিন্তু হরিপদর ভারি বদভ্যাস। এর জন্য কত ধমক, কত শাসন, কত শাস্তি, কত সাজাই যে সে পেয়েছে,ও তবু তার আক্কেল হল না। তবু সে লুকিয়ে চুরিয়ে পেটুকের মতো খাবেই। যেমন হরিপদ তেমনি তার ছোট ভাইটি। এদিকে পেট রোগা, দুদিন অন্তর অসুখ লেগেই আছে, তবু হ্যাংলামি তার আর যায় না। যেদিন শাস্তিটা একটু শক্ত রকমের হয় তারপর কয়েক দিন ধরে প্রতিজ্ঞা থাকে, ‘এমন কাজ আর করব না’। যখন অসময়ে অখাদ্য খেয়ে, রাত্রে তার পেট কামড়ায়, তখন কাঁদে আর বলে, “আর না, এইবারেই শেষ”। কিন্তু দুদিন না যেতেই আবার যেই সেই। এই তো কিছুদিন আগে পিসিমার ঘরে দই খেতে গিয়ে তারা জব্দ হয়েছিল, কিন্তু তবু তো লজ্জা নেই!

হরিপদর ছোট ভাই শ্যামাপদ এসে বলল, “দাদা, শিগগির এস। পিসিমা এই মাত্র এক হাঁড়ি দই নিয়ে তার খাটের তলায় লুকিয়ে রাখলেন।” দাদাকে এত ব্যস্ত হয়ে এ-খবরটা দেবার আর্থ এই যে, পিসিমার ঘরে যে শিকল দেওয়া থাকে, শ্যামাপদ সেটা হাতে নাগাল পায় না—তাই দাদার সাহায্য দরকার হয়। দাদা এসে আস্তে আস্তে শিকলটা খুলে আগেই তারাতাড়ি গিয়ে খাটের তলায় দইয়ের হাঁড়ি থেকে এক খাবল তুলে নিয়ে খপ করে মুখে দিয়েছে। মুখে দিয়েই চীৎকার! কথায় বলে, ‘ষাঁড়ের মত চ্যাঁচাচ্ছে’, কিন্তু হরিপদর চেঁচানো তার চাইতেও সাংঘাতিক! চীৎকার শুনে মা-মাসি-দিদি-পিসি যে যেখানে ছিলেন সব ‘কি হল’ ‘কি হল’ বলে দৌড়ে এলেন। শ্যামাপদ বুদ্ধিমান ছেলে, সে দাদার চীৎকারের নমুনা শুনেই দৌড়ে ঘোষেদের পাড়ায় গিয়ে হাজির! সেখানে অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো তার বন্ধু শান্তি ঘোষের কাছে পড়া বুঝে নিচ্ছে। এদিকে হরিপদর অবস্থা দেখে পিসিমা বুঝেছেন যে,হরিপদ দি ভেবে তাঁর চুনের হাঁড়ি চেখে বসেছে। তারপর হরিপদর যা সাজা! এক সপ্তাহ ধরে সে না পারে চিবোতে, না পারে গিলতে, তার খাওয়া নিয়েই এক মহা হাঙ্গামা! কিন্তু তবু তো তার লজ্জা নেই—আজ আবার লুকিয়ে কোথায় লাড়ু খেতে গিয়েছে। ওদিকে মামা তো ডেকে সারা!

খানিক বাদে মুখ ধুয়ে মুছে হরিপদ ভালোমানুষের মতো এসে হাজির। হরিপদর বড়মামা বললেন, “কিরে, এতক্ষণ কোথায় ছিলি?” হরিপদ বলল, “এইতো, উপরে ছিলাম।” “তবে, আমরা এত চ্যাঁচাচ্ছিলাম, তুই জবাব দিচ্ছিলি না যে?” হরিপদ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “আজ্ঞে জল খাচ্ছিলাম কিনা।” “শুধু জল?” না, কিছু স্থলও ছিল?” হরিপদ শুনে হাসতে লাগল যেন তার সঙ্গে ভারই একটা রসিকতা করা হয়েছে। এর মধ্যে তার মেজমামা মুখখানা গম্ভীর করে এসে হাজির। তিনি ভিতর থেকে খবর এনেছেন যে, হরিপদ একটু আগেই ভাঁড়ারঘরে ঢুকেছিল, আর তারপর থেকেই দশ-বারোখানা ক্ষীরের লাড়ু কম পড়েছে। তিনি এসেই হরিপদর বড়মামার সঙ্গে খানিকক্ষণ ইংরাজিতে ফিস্‌ফাস্‌ কি যেন বলাবলি করলেন, তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, “বাড়িতে ইঁদুরের যে রকম উৎপাত, ইঁদুর মারবার একটা কিছু বন্দোবস্ত না করলে আর চলছে না। চারদিকে যে রকম প্লেগ আর ব্যরাম—এই পাড়া সুদ্ধু ইঁদুর না মারলে আর রক্ষা নেই।” বড়মামা বললেন, “হ্যাঁ, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দিদিকে বলেছি, সেঁকো বিষ দিয়ে লাড়ু পাকাতে—সেইগুলো একবার ছড়িয়ে দিলেই ইঁদুর বংশ নির্বংশ হবে।” হরিপদ জিজ্ঞেস করল, “লাড়ু কবে পাকানো হবে?” বড়মামা বললেন, “সে এতক্ষণে হয়ে গেছে, সকালেই টেঁপিকে দেখছিলাম একথাল ক্ষীর নিয়ে দিদির সঙ্গে লাড়ু পাকাতে বসেছে।” হরিপদর মুখখানা আমসির মতো শুকিয়ে এল, সে খানিকটা ঢোঁক গিলে বলল, “সেঁকো বিষ খেলে কি হয় বড়মামা?” “হবে আবার কি? ইঁদুরগুলো মারা পড়ে, এই হয়।” “আর যদি মানুষে এই লাড়ু খেয়ে ফেলে?” “তা একটু আধটু যদি খেয়ে ফেলে তো নাও মরতে পারে—গলা জ্বলবে, মাথা ঘুরবে, বমি হবে, হয়তো হাত-পা খিঁচবে।” “আর যদি একেবারে এগারোটা লাড়ু খেয়ে ফেলে?” বলে হরিপদ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। তখন বড়মামা হাসি চেপে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, “বলিস কিরে? তুই খেয়েছিস নাকি?” হরিপদ কাঁদতে কাঁদতে বলল, “হ্যাঁ বড়মামা, তার মধ্যে পাঁচটা খুব বড় ছিল। তুমি শিগগির ডাক্তার ডাক বড়মামা, আমার কি রকম গা ঝিম্‌ঝিম্‌ আর বমি বমি করছে।”

মেজমামা দৌড়ে গিয়ে তার বন্ধু রমেশ ডাক্তারকে পাশের বাড়ি থেকে ডেকে আনলেন। তিনি প্রথমেই খুব একটা কড়া রকমের তেতো ওষুধ হরিপদকে খাইয়ে দিলেন। তারপর তাকে কি একটা শুঁকতে দিলেন, তার এমন ঝাঁঝ যে, বেচারার দুই চোখ দিয়ে দর্‌দর্‌ করে জল পড়তে লাগল। তারপর তাঁরা সবাই মিলে লেপ কম্বল চাপা দিয়ে তাকে ঘামিয়ে অস্থির করে তুললেন। তারপর একটা ভয়ানক উৎকট ওষুধ খাওয়ানো হল। সে এমন বিস্বাদ আর এমন দুর্গন্ধ যে, খেয়েই হরিপদ ওয়াক ওয়াক করে বমি করতে লাগল।

তারপর ডাক্তার তার পথ্যের ব্যবস্থা করে গেলেন। তিনদিন সে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না, চিরেতার জল আর সাগু খেয়ে থাকবে। হরিপদ বলল, “আমি উপরে মা-র কাছে যাব।” ডাক্তার বললেন, “না। যতক্ষণ বাঁচবার আশা আছে ততক্ষণ নাড়াচাড়া করে কাজ নেই। ও আপনাদের এখানেই থাকবে।” বড়মামা বললেন, “হ্যাঁ, মা-র কাছে যাবে না আরো কিছু! মাকে এখন ভাবিয়ে তুলে তোমার লাভ কি? তাঁকে এখন খবর দেবার কিছু দরকার নেই।”

তিনদিন পরে যখন সে ছাড়া পেল তখন হরিপদ আর সেই হরিপদ নেই, সে একেবারে বদলে গেছে। তার বাড়ির লোকে সবাই জানে হরিপদর ভারি ব্যারাম হয়েছিল। তার মা জানেন যে বেশি পিঠে খেয়েছিল বলে হরিপদর পেটের অসুখ হয়েছিল। হরিপদ জানে, সেঁকো বিষ খেয়ে সে আরেকটু হলেই মারা যাচ্ছিল। কিন্তু আসল ব্যাপারটা যে কি, তা জানেন কেবল হরিপদর বড়মামা আর মেজোমামা, আর জানেন রমেশ ডাক্তার—আর এখন জানলে তোমরা, যারা এই গল্প পড়েছ।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments