Tuesday, April 23, 2024
Homeরম্য গল্পনতুনদা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

নতুনদা – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

'নতুনদা' শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

দাঁড় বাধিয়া পাল খাটাইয়া ঠিক হইয়া বসিয়াছি। অনেক বিলম্বে ইন্দ্রের নতুনদা আসিয়া ঘাটে পোঁছিলেন। চাঁদের আলোতে তাহাকে দেখিয়া ভয় পাইয়া গেলাম। কলকাতার বাবু অর্থাৎ ভয়ংকর বাবু। সিষ্কের মোজা, চ্কচকে পাম্প–সু, আগাগোড়া ওভারকোটে মোড়া, গলায় গলাবন্ধ, হাতে দস্তানা, মাথায় টুপি, পশ্চিমের শীতের বিরুদ্ধে তাহার সতর্কতার অন্ত নাই। আমাদের সাধের ডিঙিটাকে তিনি অত্যন্ত যাচ্ছেতাই বলিয়া কঠোর মত প্রকাশ করিয়া ইন্দ্রের কাঁধে ভর দিয়া আমার হাত ধরিয়া অনেক কষ্টে, অনেক সাবধানে নৌকার মাঝখানে জাঁকিয়া বসিলেন।

‘তোর নাম কি রে ?

ভয়ে ভয়ে বলিলাম, ‘শ্রীকান্ত’।

তিনি দাঁত খিঁচাইয়া বলিলেন, ‘আবার শ্রী-কান্ত। শুধু কান্ত। নে, তামাক সাজ।’

ইন্দ্র অপ্রতিভ হইয়া কহিল, ‘শ্রীকান্ত তুই এসে একটু হাল ধর্, আমি তামাক সাজছি।’

আমি তাহার জবাব না দিয়া তামাক সাজিতে লাগিয়া গেলাম। তামাক সাজিয়া হুঁকা হাতে দিতে, তিনি প্রসন্নমুখে টানিতে টানিতে প্রশ্ন করিলেন, ‘তুই থাকিস কোথা রে কান্ত? তোর গায়ে ওটা কালোপানা কিরে? র‌্যাপার? আহা! র‌্যাপারের কী শ্রী! তেলের গন্ধে ভূত পালায়। পেতে দে দেখি, বসি!’

“আমি দিচ্ছি নতুনদা। আমার শীত করছে না—এই নাও’ বলিয়া ইন্দ্র নিজের গায়ের আলোয়ানটা তাড়াতাড়ি ছুড়িয়া ফেলিয়া দিল। তিনি সেটা জড়ো করিয়া লইয়া বেশ করিয়া বসিয়া মুখে তামাক টানিতে লাগিলেন।

শীতের গঙ্গা। অধিক প্রশস্ত নয়—আধঘন্টার মধ্যে ডিঙি ওপারে গিয়া ভিড়িল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাতাস পড়িয়া গেল। ইন্দ্র ব্যাকুল হইয়া কহিল, ‘নতুনদা, এ যে ভারি মুশকিল হল, হাওয়া পড়ে গেল। আর তো পাল চলবে না।’ নতুনদা জবাব দিলেন, ‘এই ছোঁড়াটাকে দে-না দাঁড় টানুক।’

কলিকাতাবাসী নতুনদার অভিজ্ঞতায় ইন্দ্র ঈষৎ ম্লান হাসিয়া কহিল, ‘দাঁড়। কারুর সাধ্যি নেই নতুনদা, এই স্রোত ঠেলে উজান বেয়ে যায়। আমাদের ফিরতে হবে।’

প্রস্তাব শুনিয়া নতুনদা একমুহূর্তে একেবারে অগ্নিশর্মা হইয়া উঠিলেন—‘তবে আনলি কেন হতভাগা? যেমন করে হোক, তোকে পৌঁছে দিতেই হবে। আমার থিয়েটারে হারমোনিয়াম বাজাতেই হবে। তারা বিশেষ করে ধরেছে।’

ইন্দ্রের অবস্থা সংকট অনুভব করিয়া আমি আস্তে আস্তে কহিলাম, ‘ইন্দ্র, গুণ টেনে নিয়ে গেলে হয় না?’ বাবু অমনি দাতমুখ ভেংচাইয়া বলিলেন, ‘তবে যাও না, টানো গে নাহে। জানোয়ারের মতো বসে থাকা হচ্ছে কেন?’

তারপরে একবার ইন্দ্র, একবার আমি, গুণ টানিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলাম। কখনোবা উঁচু পাড়ের উপর দিয়া, কখনো বা নিচে নামিয়া এবং সময়ে সময়ে সেই বরফের মতো ঠান্ডা জলের ধার ঘেঁষিয়া অত্যন্ত কষ্ট করিয়া চলিতে হইল। আবার তাহারই মাঝে মাঝে বাবুর তামাক সাজার জন্য নৌকা থামাইতে হইল। অথচ বাবুটি ঠায় বসিয়া রহিলেন— এতটুকু সাহায্য করিলেন না। ইন্দ্র একবার তাহাকে হাল ধরিতে বলায় জবাব দিলেন, তিনি দস্তানা খুলিয়া এই ঠান্ডায় নিউমোনিয়া করিতে পারিবেন না। ইন্দ্র বলিতে গেল, না- খুলে—

হ্যা, আমি দস্তানাটা মাটি করে ফেলি আর কি! নে—যা করছিস কর।’

আরও বিপদ গঙ্গার রুচিকর হাওয়ায় বাবুর ক্ষুধার উদ্রেক হইল; বলিলেন, ‘হ্যাঁরে ইন্দ্র, এদিকে খোট্টামোট্টাদের বসতি–টসতি নেই? মুড়ি–টুড়ি পাওয়া যায় না ?’

ইন্দ্র কহিল, “সামনেই একটা বেশ বড় বসতি নতুনদা, সব জিনিস পাওয়া যায়।

‘তবে লাগা–ওরে ছোঁড়া! টা না একটু জোরে, ভাত খাসনে ?

অনতিকাল পরে আমরা একটা গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইলাম।

ডিঙি জোর করিয়া ধাক্কা দিয়া সংকীর্ণ জলে তুলিয়া দিয়া আমরা দুজনে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম।

বাবু কহিলেন, ‘হাত–পা একটু খেলানো চাই। নামা দরকার।’ অতএব ইন্দ্র তাহাকে কাঁধে করিয়া নামাইয়া আনিল।

আমরা দুজনে তাহার ক্ষুধাশান্তির উদ্দেশ্যে গ্রামের ভিতরে যাত্রা করিলাম। এ অঞ্চলে পথ–ঘাট, দোকান–পাট সমস্তই ইন্দ্রের জানা ছিল। সে গিয়া মুদির দোকানে উপস্থিত হইল। কিন্তু দোকান বন্ধ এবং দোকানি শীতের ভয়ে দরজা জানালা রুদ্ধ করিয়া গভীর নিদ্রায় মগ্ন। উভয়ে বাহিরে দাঁড়াইয়া তারস্বরে চিৎকার করিয়া এবং যতপ্রকার ফন্দি মানুষের মাথায় আসিতে পারে, তাহার সবগুলি একে একে চেষ্টা করিয়া আধঘণ্টা পরে রিক্তহস্তে ফিরিয়া আসিলাম। কিন্তু ঘাট যে জনশূন্য! জ্যোৎস্নালোকে যতদূর দৃষ্টি চলে ততদূরই যে শূন্য! ডিঙি যেমন ছিল তেমনি রহিয়াছে, কিন্তু ইনি কোথায় গেলেন! দুজনে প্রাণপণে চিৎকার করিলাম, ‘নতুনদা। কিন্তু কোথায় কে?

এ অঞ্চলে মাঝে মাঝে শীতকালে বাঘের উৎপাতের কথাও শোনা যাইত। সহসা ইন্দ্র সেই কথাই বলিয়া বসিল—‘বাঘে নিলে না তো-রে?’ সহসা উভয়েরই চোখে পড়িল কিছুদূরে বালির উপর কী একটা বস্তু চাঁদের আলোয় চকচক করিতেছে। কাছে গিয়া দেখি, তাহারই সেই বহুমূল্য পাম্প-সুর একপাটি। ইন্দ্র সেই ভিজা বালির উপরেই একেবারে শুইয়া পড়িয়া বলিল—‘শ্রীকান্তরে, আমার মাসিমাও এসেছেন যে, আমি আর বাড়ি ফিরে যাব না।’

তখন ধীরে ধীরে সমস্ত বিষয়টাই পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে লাগিল। আমরা যখন মুদির দোকানে দাঁড়াইয়া দোকানিকে জাগাইবার নিষ্ফল চেষ্টা করিতেছিলাম, তখন এইদিকের কুকুরগুলিও যে সমবেত আর্তচিৎকারে এই দুর্ঘটনার সংবাদটাই আমাদের গোচর করিবার ব্যর্থ প্রয়াস পাইতেছিল, তাহা জলের মতো বুঝিতে পারিলাম। এখনও দূরে তাহাদের ডাক শোনা যাইতেছে। সুতরাং আর সংশয় মাত্র রহিল না যে, নেকড়েগুলি তাহাকে টানিয়া লইয়া গিয়া যেখানে ভোজ করিতেছে, তাহারই আশেপাশে দাঁড়াইয়া কুকুরগুলি এখন চেঁচাইয়া মরিতেছে।

অকস্মাৎ ইন্দ্র সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া কহিল, ‘আমি যাব।’ আমি সভয়ে তাহার হাত চাপিয়া ধরিলাম, ‘পাগল হয়েছ। ভাই।’ ইন্দ্র তাহার জবাব দিল না। একটা বড় ছুরি পকেট হইতে বাহির করিয়া বাঁ-হাতে লইয়া সে কহিল, ‘তুই থাক শ্রীকান্ত, আমি না এলে ফিরে গিয়ে বাড়িতে খবর দিস—আমি চললুম।’

আমি নিশ্চয় জানিতাম, কোনোমতেই তাহাকে নিরস্ত করা যাইবে না—সে যাইবেই। কিন্তু আমারও তো যাওয়া চাই। আমিও নিতান্ত ভীরু ছিলাম না। অতএব একটি বাঁশ সংগ্রহ করিয়া লইয়া দাড়াইলাম এবং তাহার সহিত ধীরে ধীরে অগ্রসর হইলাম। সম্মুখে একটা বালির ঢিপি ছিল, সেইটা অতিক্রম করিয়াই দেখা গেল, অনেক দূরে জলের ধার ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া পাঁচ-সাতটা কুকুর চিঙ্কার করিতেছে। যতদুর দেখা গেল, একপাল কুকুর ছাড়া বাঘ তো দূরের কথা একটা শৃগালও নাই। সন্তর্পণে আরও কতকটা অগ্রসর হইতেই মনে হইল, তাহারা কী একটা কালোপানা বস্তু জলে ফেলিয়া পাহারা দিয়া আছে।

ইন্দ্র চিৎকার করিয়া ডাকিল, ‘নতুনদা।’ নতুনদা গলা জলে দাঁড়াইয়া অব্যক্তস্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন—‘এই যে আমি।’ দুজনে প্রাণপণে ছুটিয়া গেলাম, কুকুরগুলি সরিয়া দাঁড়াইল এবং ইন্দ্র ঝাপাইয়া পড়িয়া আকণ্ঠ নিমজ্জিত মূৰ্ছিত—প্রায় তাহার দর্জিপাড়ার মাসতুত ভাইকে টানিয়া তীরে তুলিল। তখনও তাহার একটা পায়ে বহু মূল্যবান পাম্প-সু, গায়ে ওভারকোট, হাতে দস্তানা, গলায় গলাবন্ধ এবং মাথায় টুপি ভিজিয়া ফুলিয়া ঢোল হইয়া উঠিয়াছে।

আমরা চলিয়া গেলে গ্রামের কুকুরগুলি তাহার অদৃষ্টপূর্ব পোশাকের ছটায় বিভ্রান্ত হইয়া এই মহামান্য ব্যক্তিটিকে তাড়া করিয়াছিল। এতটা আসিয়াও আত্মরক্ষার কোনো উপায় খুঁজিয়া না পাইয়া অবশেষে তিনি জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িয়াছিলেন এবং এই দুর্দান্ত শীতের রাত্রে তুষার–শীতল জলে আকণ্ঠ মগ্ন থাকিয়া এই অধঘণ্টাকাল ব্যাপিয়া পূর্বকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতেছিলেন। কিন্তু প্রায়শ্চিত্তের ঘোর কাটাইয়া তাহাকে চাঙা করিয়া তুলিতেও সে রাত্রে আমাদিগকে কম মেহনত করিতে হয় নাই। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে, বাবু ডাঙায় উঠিয়া প্রথম কথা কহিলেন, ‘আমার একপাটি পাম্প ?’

(সমাপ্ত)

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments