Wednesday, April 24, 2024
Homeকিশোর গল্পএকটি মামদো ভূতের গল্প - হুমায়ূন আহমেদ

একটি মামদো ভূতের গল্প – হুমায়ূন আহমেদ

একটি মামদো ভূতের গল্প - হুমায়ূন আহমেদ

আজ নীলুর জন্মদিন।

জন্মদিনে খুব লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকতে হয়। তাই নীলু সারা দিন খুব লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকল। ছোট কাকু তাকে রাগাবার জন্যে কতবার বললেন :

নীলু বড় বোকা
খায় শুধু পোকা

তবু নীলু একটুও রাগ কল না। শুধু হাসল। বাবা বললেন নীলু মা টেবিল থেকে আমার চশমাটা এনে দাও তো। নীলু দৌড়ে চশমা এনে দিল। হাত থেকে ফেলে দিল। কুলপি মালাইওয়ালা বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে হেঁকে ডাকল, চাই কুলপি মালাই। কিন্তু নীলু অন্য দিনের মতো বলল না, বাবা আমি কুলপি মালাই খাব–জন্মদিনে নিজ থেকে কিছু চাইতে নেই তো, তাই।

কিন্তু সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেল। তখন নীলুর অঙ্ক স্যার এসেছেন, নীলু বইখাতা নিয়ে বসেছে মাত্র। পড়া শুরু হয়নি। নীলুর ছোট কাকু এসে বললেন, আজ তোমার পড়তে হবে না নীলু।

কেন কাকু?

তোমার মার খুব অসুখ। তুমি দোতলায় যাও।

নীলু দোতলায় উঠে দেখে চারদিক কেমন চুপচাপ। কালো ব্যাগ হাতে একজন ডাক্তার বসে আছেন বারান্দায়। নীলুর বাবা গম্ভীর হয়ে শুধু সিগারেট টানছেন। কিছুক্ষণ পর মস্ত গাড়ি করে একজন বুড়ো ডাক্তার এলেন। খুব রাগী চেহারা তার। এইসব দেখে নীলুর ভীষণ কান্না পেয়ে গেল। সে এখন বড় হয়েছে। বড় মেয়েদের কাঁদতে নেই, তবু সে কেঁদে ফেলল। বাবা বললেন, নীলু, নীচে যাও তো মা। কাঁদছ কেন বোকা মেয়ে? কিন্তু নীলুর এত খারাপ লাগছে যে না কেঁদে কী করবে? আজ ভোরবেলায়ও সে দেখেছে মার কিছু হয়নি। তাকে হাসতে হাসতে বলেছেন, জন্মদিনে এবার নীলুর কোনো উপহার কেনা হয়নি। কী মজা! কিন্তু নীলু জানে মা মিথ্যে বলছেন। সে দেখেছে বাবা সোনালি কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট এনে শেলফের উপর রেখেছেন। লাল ফিতে দিয়ে প্যাকেটটা বাধা। নীলু ছুঁয়ে দেখতে গেছে। বাবা চেঁচিয়ে বলেছেন এখন নয়, এখন নয়। রাত্রিবেলা দেখবে।

এর মধ্যে কী আছে বাবা? বলবে না, কার জন্যে এনেছ, আমার জন্যে?

তাও বলব না।

এই বলেই বাবা হাসতে শুরু করেছেন। তার সঙ্গে সঙ্গে মাও। নীলু বুঝতে পেরেছে এখানেই লুকোনো তার জন্মদিনের উপহার। মা যদি ভালো থাকতেন তাহলে এতক্ষণে কী মজাটাই না হতো। ছাদে চেয়ার পেতে সবাই গোল হয়ে বসত। সবাই মিলে চা খেত, নীলু এমনিতে চা খায় না। কিন্তু জন্মদিন এলে মা তাকেও চা দিতেন। তারপর মা একটি গান করতেন। (মা যা সুন্দর গান করেন।), নীলু একটা ছড়া বলত। সবশেষে বাবা বলতেন, আমাদের আদরের মা, মৌটুসকী মা, টুনটুনি মার জন্মদিনে এই উপহার। এই বলে চুমু খেতেন নীলুর কপালে। আর নীলু হয়তো তখন আনন্দে কেঁদেই ফেলত। সোনালি কাগজে মোড়া প্যাকেটটি খুলত ধীরে ধীরে। সেই প্যাকেটে দেখত ভারি চমৎকার কোনো জিনিস!

কিন্তু মার হঠাৎ এমন অসুখ করল! নীলুর কিছু ভালো লাগছে না। ছোট। কাকু বললেন, এসো মা, আমরা ছাদে বসে গল্প করি।

উহুঁ।

লাল কমল নীল কমলের গল্প শুনবে না?

উহুঁ।

নীলু ফ্রকের হাতায় চোখ মুছতে লাগল।

একটু পরে এলেন বড় ফুফু। নীলু যে একা একা দাঁড়িয়ে কাঁদছে তা দেখেও দেখলেন না। তরতর করে উঠে গেলেন দোতলায়। তখনই নীলু শুনল তার মা কাঁদছেন। খুব কাদছেন। মাকে এর আগে নীলু কখনো কাঁদতে শোনেনি। একবার মার হাত কেটে গেল বঁটিতে। কী রক্ত কিন্তু মা একটুও কাদেননি। নীলুকে বলেছেন, আমার হাত কেটেছে তুমি কেন কাঁদছ? বোকা মেয়ে।

আজ হঠাৎ করে তার কান্না শুনে ভীষণ ভয় করতে লাগল তার। ছোট কাকু বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে ছিলেন, নীলু তার কাছে যেতেই নীলুকে তিনি কোলে তুলে নিলেন। নীলু ফোপাতে ফোপাতে বলল, মার কী হয়েছে ছোট কাকু?

কিছু হয়নি।

তবে মা কাঁদছে কেন?

অসুখ করেছে। সেরে যাবে।

অসুখ করলে সবাই কাঁদে, তাই না?

হ্যাঁ।

আবার অসুখ সেরেও যায়। যায় না? যায়।

কাজেই অসুখ করলে মন খারাপ করতে নেই বুঝলে পাগলি?

হু।

নীলুর কান্না থেমে গেল ছোট কাকুর কথা শুনে। কিন্তু ঠিক তক্ষুনি পো পো শব্দ করতে করতে হাসপাতালের গাড়ি এসে করে তার মাকে নিয়ে তুলছে সেই গাড়িটিতে। ছোট কাকু শক্ত করে নীলুর হাত ধরে রেখেছেন। নইলে সে চলে যেত মার কাছে।

বাবাও যাচ্ছেন সেই গাড়িতে। যাবার আগে নীলুর মাথায় হাত রেখে বললেন, কাঁদে না লক্ষ্মী মা, ছোট কাকুর সঙ্গে থাকো। আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। নীলু বলল, মার কী হয়েছে?

কিছু হয়নি।

মাকে গাড়িতে তুলে লোকগুলো দরজা বন্ধ করে দিল। পো পো শব্দ করতে লাগল গাড়ি। বাবা উঠলেন ফুফুর সাদা গাড়িটায়। গাড়ি যখন চলতে শুরু করেছে, তখন জানালা দিয়ে মুখ বের করে তিনি নীলুকে ডাকলেন।

নীলু, ওমা নীলু।

কী বাবা?

নীলুর ইচ্ছে হলো চেঁচিয়ে বলে, চাই না উপহার। আমার কিছু লাগবে না। কিছু বলার আগেই ছোট কাকু নীলুকে কোলে করে নিয়ে এলেন দোতলায়।

তাকে সোফায় বসিয়ে নিয়ে এলেন সোনালি রঙের প্যাকেটটি।

দেখি লক্ষ্মী মেয়ে, প্যাকেটটা খোলো দেখি।

না।

আহা খোলো নীলু, দেখি কী আছে। নীলুর একটুও ভালো লাগছিল না। তবু সে খুলে ফেলল। আর অবাক হয়ে দেখল চমৎকার একটি পুতুল। ছোট কাকু চেটিয়ে উঠলেন, কী সুন্দর। কী সুন্দর।

ধবধবে সাদা মোমের মতো গা। লাল টুকটুকে ঠোঁট। কোঁকড়ানো ঘন কালো চুল। আর কী সুন্দর তার চোখ নীল রঙের একটি ফ্রক তার গায়ে, কী চমৎকার মানিয়েছে। নীলুর এত ভালো লাগল পুতুলটা। ছোট কাকু বললেন, কী নাম রাখবে পুতুলের?

নাম রাখতে হবে এ কথা নীলুর মনেই ছিল না। তাই তো, কী নাম রাখা যায়?

তুমি একটা নাম বলো কাকু।

এ্যানি রাখবে নাকি? মেম পুতুল তো, কাজেই বিলিতি নাম।

এটা মেম পুতুল কাকু?

হু। দেখছ না নীল চোখ। মেমদের চোখ থাকে নীল।

আরে তাই তো এতক্ষণ লক্ষই করেনি নীলু। পুতুলটির চোখ দুটি ঘন। নীল। সেই চোখে পুতুলটি আবার মিটমিট করে চায়।

ছোট কাকু, আমি এর নাম রাখব সোনামণি।

এ্যা ছিঃ সোনামণি তো বাজে নাম। তার চে বরং সুস্মিতা রাখা যায়।

উহুঁ, সোনামণি রাখব।

আচ্ছা বেশ বেশ। সোনামণিও মন্দ নয়।

নীলু সাবধানে সোনামণিকে বসাল টেবিলে। কী সুন্দর। কী সুন্দর। শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়।

রাতের বেলা খেতে বসল তারা, তিনজন। নীলু ছোট কাকু আর সোনামণি। সোনামণি তো খাবে না, শুধু শুধু বসেছে।

ছোট কাকু খেতে খেতে মজার মজার গল্প করতে লাগলেন। বেকুব বামুনের গল্প শুনে নীলু হেসে বাঁচে না। ছোট কাকু যা হাসাতে পারেন। একসময় নীলু বলল, এবার একটা ভূতের গল্প বলো।

না, ভূতের গল্প শুনে তুমি ভয়ে কেঁদে ফেলবে।

ইস, আমি বুঝি ছোট মেয়ে বলে কাকু।

মামদো ভূতের গল্প বলব নাকি তবে?

মামদো ভূত কি মানুষ খায় কাকু?

খায় না আবার সুবিধামতো পেলেই কোৎ করে গিলে ফেলে।

ধড়াস করে উঠল নীলুর বুকটা। ছোট কাকু বললেন, তবে যে বলেছিলে ভয় পাবে না? এখন দেখি নীল হয়ে গেছ ভয়ে। কী সাহসী মেয়ে আমাদের নীলু।

একটুও ভয় পাইনি আমি, সত্যি বলছি।

নীলুর অবশ্য খুব ভয় লাগছিল। তবু সে এমন ভান করল, যেন একটুও ভয় পায়নি।

ছোট কাকু, দেখবে, আমি একা একা বারান্দায় যাব?

ছোট কাকু কিছু বলার আগেই ঝন ঝন করে টেলিফোন বেজে হাসপাতাল থেকে টেলিফোন করেছে। ছোট কাকু নীলুকে কি ছুঁই বললেন না। তবু নীলু বুঝল মায়ের অসুখ খুব বেড়েছে। সে ভয়ে ভয়ে বলল, গল্পটা বলবে না কাকু?

কোন গল্প?

ঐ যে, মামদো ভূতের গল্প? ছোট কাকু হাত নেড়ে বললেন, আরে পাগলি, ভূত বলে আবার কিছু আছে। নাকি! সব বাজে কথা।

বাজে কথা?

হ্যাঁ, খুব বাজে কথা। ভূত–প্রেত বলে কিছু নেই। সব মানুষের বানানো গল্প।

তুমি ভূত ভয় করো না কাকু?

আরে দূর। ভূত থাকলে তো ভয় করব!

এই বলেই ছোট কাকু আবার গম্ভীর হয়ে পড়লেন।

নীলুকে সবাই বলে ছোট মেয়ে ছোট মেয়ে। কিন্তু সে সব বুঝতে পারে। ছোট কাকুর হঠাৎ গম্ভীর হওয়া দেখেই সে বুঝতে পারছে মায়ের খুব বেশি অসুখ। নীলুর খুব খারাপ লাগতে লাগল। এত খারাপ যে, চোখে পানি এসে গেল। ছোট কাকু অবিশ্যি দেখতে পেলেন না–কারণ তার কাছে আবার টেলিফোন এসেছে। নীলু শুনতে পেল ছোট কাকু বললেন–
হ্যালো। হ্যাঁ হ্যাঁ।

এ তো দারুণ ভয়ের ব্যাপার।

হ্যাঁ, নীলু ভাত খেয়েছে।

দিচ্ছি, এক্ষুনি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।

আচ্ছা আচ্ছা।

টেলিফোন নামিয়ে রেখেই ছোট কাকু বললেন, ঘুমুতে যাও নীলু।

নীলু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, মার কী হয়েছে কাকু?

কিছু হয়নি রে বেটি।

মা কখন আসবে?

কাল ভোরে এসে যাবে। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো। ঘুম ভাঙতেই দেখবে মা এসে গেছেন।

নীলুর ঘরটি মার ঘরের মধ্যেই। শুধু পারটেক্সের দেয়াল দিয়ে করা। নীলু এখন বড় হয়েছে, তাই একা শোয়। তার একটুও ভয় করে না। তা ছাড়া সারা রাত মা কতবার এসে খোঁজ নিয়ে যান। নীলুর গায়ের কম্বল টেনে দেন। কপালে চুমু খান। কিন্তু আজ নীলু একা। ছোট কাকু বললেন, ভয় লাগবে না তো মা? মাথার কাছের জানালা বন্ধ করে দেব?

দাও।

মন? তোমার মার কোনো খবর আসে। যদি, সে জন্যে। আচ্ছা?

আচ্ছা।

তুমি পুতুল নিয়ে ঘুমুচ্ছ বুঝি নীলু?

হ্যাঁ কাকু।

ভয় পেলে আমাকে ডাকবে, কেমন?

ডাকব।

ছোট কাকু ঘরের পর্দা ফেলে চলে গেলেন। নীলুর কিন্তু ঘুম এলো না। সে জেগে জেগে ঘড়ির শব্দ শুনতে লাগল। টিক টিক টিক টিক। কিছুক্ষণ পর শুনল ছোট কাকু রেডিও চালু করে কী যেন শুনছেন। বক্তৃতাটতা হবে। তারপর আবার রেডিও বন্ধ হয়ে গেল। বারান্দার বাতি জ্বলল একবার। আবার নিভে গেল। রাত বাড়তে লাগল। নীলুর একফোঁটাও ঘুম এলো না। একসময় খুব পানির পিপাসা হলো তার। বিছানায় উঠে বসে ডাকল, ছোট কাকু, ছোট কাকু?

কেউ সাড়া দিল না। ছোট কাকুও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। নীলুর একটু ভয় ভয় করতে লাগল। আর ঠিক সেই সময় নীলুর মাথার জানালায় ঠক ঠক করে কে যেন শব্দ করল। আবার শব্দ হলো। সে সঙ্গে কে যেন ডাকল।

নীলু নীঈঈঈলুউউ।

নীলুর ভীষণ ভয় লাগলেও সে বলল, কে?

আমি। জানালা খোলো।

নীলু দারুণ অবাক হয়ে গেল। জানালার ওপাশে কে থাকবে? সেখানে তো দাঁড়াবার জায়গা নেই। নীলু বলল, কে আপনি?

আমি ভূত। জানালা খোলো মেয়ে।

নীলুর একটু একটু ভয় করছিল। তবু সে জানালাটা খুলে ফেলল। বাইরে ফুটফুটে জ্যোস্না। গাছের পাতা চিকমিক করছে। নীলু অবাক হয়ে দেখল ফুটফুটে জ্যোস্নায় লম্বা মিশমিশে কালো কী একটা জিনিস যেন বাতাসে ভাসছে। ওমা, ভূতের মতোই তো লাগছে। ভূতটি বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ নাকি মা?

নীলু কোনোমতে বলল, না, পাচ্ছি না তো।

বেশ বেশ। বড় মানুষেরা ভূত দেখলে যা ভয় পায়? এতক্ষণে হয়তো ফিট হয়ে উল্টে পড়ত। তুমি তো বাচ্চামেয়ে। তাই ভয় পাওনি।

নীলু গম্ভীর হয়ে বলল, কে বলল আমি বাচ্চামেয়ে? আমি অনেক বড় হয়েছি।

ভূতটি খিলবিল করে হেসে উঠল। হাসি আর থামতেই চায় না। একসময় হাসি থামিয়ে বলল, অনেক বড় হয়েছ তুমি, হা হা।

নীলু বলল, ভেতরে আসো তুমি। বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? নীলুর এই কথায় ভূতটি রেগে গিয়ে বলল, তুমি করে বলছ কেন আমাকে? বড়দের আপনি করে বলতে হয় না?

নীলু লজ্জা পেয়ে বলল, ভেতরে আসুন আপনি।

ভূতটি সুট করে ঢুকে পড়ল ঘরে। ওমা কী লম্বা, আর কী মিশমিশে কালো। রঙ! এত বড় বড় চোখ। দাঁত বের করে খুব খানিকক্ষণ হেসে সে বলল, আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছ না তো মা?

নীলুর তখন একটুও ভয় লাগছে না। ভূতটি অবিশ্যি দেখতে খুব বাজে। গল্পের বইয়ে যেসব ভূত-প্রেতের ছবি থাকে, তার চেয়েও বাজে। তবু ভূতটা এমন আদর করে কথা বলতে লাগল যে নীলুর ভয়ের বদলে খুব মজা লাগল। নীলু বলল, আমি ভয় পাইনি, সত্যি বলছি, একটুও না। আপনি ওই চেয়ারটায় বসুন।

ভূতটা আরাম করে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল চেয়ারে। পকেট থেকে কলাপাতার রুমাল বের করে ঘাড় মুছতে মুছতে বলল, খুব পরিশ্রম হয়েছে। বাতাসের উপর দাঁড়িয়ে ছিলাম কিনা, তাই। তোমার ঘরে কোনো ফ্যান নেই মা? যা গরম।

জ্বি না, আমার ঘরে নেই। মার ঘরে আছে।

ভূতটা রুমাল দুলিয়ে হওয়া খেতে লাগল। একটু ঠাণ্ডা হয়ে বলল, তোমার কাছে একটা জরুরি কাজে এসেছি গো মেয়ে।

কী কাজ?

আর বোলো না মা। আমার একটি বাচ্চামেয়ে আছে, ঠিক তোমার বয়সী। কিন্তু তোমার মতো লক্ষ্মী মেয়ে নয় সে। ভীষণ দুষ্ট। দুদিন ধরে সে শুধু কান্নাকাটি করছে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ।

নীলু অবাক হয়ে বলল, ওমা, কী জন্যে?

সে চায় মানুষের মেয়ের সঙ্গে ভাব করতে। এমন কথা শুনেছ কখনো? মেয়েটার মাথাই খারাপ হয়ে গেছে বোধ হয়। ভূতটা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়তে লাগল। নীলু বলল,

আহা, তাকে নিয়ে এলেন না কেন? আমার সঙ্গে ভাব করতে পারত।

ভূতটা বিরক্ত হয়ে বলল, এনেছি তাকে। তার আবার ভীষণ লজ্জা। ভেতরে আসবে না।

কোথায় আছে সে?

জানালার ওপাশে বাতাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সেই তখন থেকে।

ভূতটা গলা উচিয়ে ডাকল, হইয়ু, হ-ই-যু।

জানালার ওপাশ থেকে কে একজন চিকন সুরে বলল, কী বাবা?

ভেতরে আয় মা।

না, আমার লজ্জা লাগছে।

নীলু বলল, লজ্জা কী, এসো। আমার সঙ্গে ভাব করবে।

জানালার ওপাশ থেকে ভূতের মেয়ে বলল,

তুমি এসে নিয়ে যাও।

নীলু জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে ভূতের ছোট্ট মেয়েটি একা একা বাতাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তার এমন লজ্জা যে নীলুকে দেখেই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। নীলু হাত ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে এসে মিষ্টি করে বলল, তোমার নাম কী ভাই ভূতের মেয়ে?

হইয়ু আমার নাম। তোমার নাম নীলু, তাই না?

উহুঁ, আমার নাম নীলাঞ্জনা। বাবা আদর করে ডাকেন নীলু।

হইয়ুর বাবা বললেন, কী রে পাগলি, ভাব হলো নীলুর সঙ্গে?

হ্যাঁ।

মানুষের মেয়েকে কেমন লাগল রে বেটি?

খুব ভালো। বাবা একটা কথা শোনো?

বল।

নীলুকে আমাদের বাসায় নিয়ে চলো বাবা।

বলিস কী! কী আজগুবি কথাবার্তা।

না বাবা, নিয়ে চলো। আমাদের সঙ্গে তেতুলগাছে থাকবে।

কী রকম পাগলের মতো কথা বলে!

হইয়ু ফিচফিচ করে কাঁদতে শুরু করল। হইয়ুর বাবা রেগে গিয়ে বলল, আরে পাগলি মেয়ে, মানুষের মেয়ে বুঝি আমাদের মতো তেতুলগাছে থাকতে পারে? বৃষ্টি হলেই তো ভিজে সর্দি লেগে নিউমোনিয়া হয়ে যাবে।

হোক নিউমোনিয়া, ওকে নিতে হবে।

হইয়ুর কাঁদা আরও বেড়ে গেল। নীলু খুব মিষ্টি করে বলল, আমি চলে গেলে আমার মা যে কাঁদবে ভাই।

এই কথায় মনে হলো হইয়ুর মন ভিজেছে। সে পিটপিট করে তাকাল নীলুর দিকে। হইয়ুর বাবা বলল, আহ্লাদি করিস না হইয়ু। নীলুর সঙ্গে খেলা কর।

নীলু বলল, কী খেলবে ভাই ভূতের মেয়ে? পুতুল খেলবে? নীলু তার জন্মদিনের পুতুল বের করে আনল। হইয়ুকে বলল, এর নাম সোনামণি, তুমি সোনামণিকে কোলে নেবে হইয়ু?

হইয়ু হাত বাড়িয়ে পুতুল নিল। হইয়ু নেজে কখনও এত সুন্দর পুতুল দেখেনি। সে হা করে পুতুলের দিকে তাকিয়ে রইল। হইয়ুর বাবাও মাথা নেড়ে বারবার বলল, বড় সুন্দর! বড় সুন্দর! দেখিস হইয়ু, ভাঙিস না আবার।

এই কথায় হইয়ু জিভ বের করে তার বাবাকে ভেংচি কাটল। হইয়ুর বাবা বলল, দেখলে নীলু, কেমন বেয়াদব হয়েছে? এই হইয়ু, থাপ্পড় খাবি। পাজি মেয়ে।

হইয়ু তার বাবার দিকে ফিরেও তাকাল না। পুতুল নিয়ে তার কী আনন্দ অন্যদিকে মন দেয়ার ফুরসত নেই। হইয়ুর বাবা বলল, নীলু মা, তোমরা গল্পগুজব করো। আমি পাশের ঘরে একটু বসি। দারুণ ঘুম পাচ্ছে।

নীলু চমকে উঠে বলল, ওমা, ওই ঘরে ছোট কাকু বসে আছে যে! আপনাকে দেখে ছোট কাকু ভয় পাবে।

ভয় পাবে নাকি?

নীলু মাথা নেড়ে বলল, হু, পাবে। ছোট কাকু অবশ্য বলে, ভূত-টুত কিছু নেই। মানুষের বানানো সব। তবু আমি জানি আপনাকে দেখে সে ভয় পাবে।

ভূত এ কথা শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইল। শেষে বলল, তোমার ছোট কাকু ভূত বিশ্বাস করে না?

জি না।

একটুও না?

উহুঁ।

আচ্ছা দেখাচ্ছি মজা।

নীলু ভয়ে পেয়ে বসল, না না, ছোট কাকু খুব ভালো। সত্যি বলছি।

ভূতটা হাসিমুখে বলল, বেশি ভয় দেখাব না নীলু। অল্প, খুব অল্প। দেখবে কেমন মজা হয়।

নীলু কী আর করে। খানিকক্ষণ ভেবেটেবে রাজি হয়ে গেল। ভূতটা হইয়ুকে বলল, হইয়ু মা, নীলুর খাটের নীচে বসে থাক। নীলুর কাকা যদি ভয় পেয়ে এ ঘরে আসেন তবে তোকে দেখে আরও ভয় পাবেন।

এই বলে ভূত পর্দা সরিয়ে চলে গেল পাশের ঘরে। আর হইয়ু বলল, নীলু, তোমার পুতুলটা নিয়ে যাই সঙ্গে?

আচ্ছা যাও।

নীলুর কথা শেষ হবার আগেই ও-ঘর থেকে একটা চেয়ার উল্টে পড়ার শব্দ হলো। তারপর শোনা গেল ছোট কাকু চেঁচিয়ে বললেন, এটা কী আরে এটা কী!

ধড়মড় করে শব্দ হলো একটা। আর ছোট কাকু হাপাতে হাপাতে দৌড়ে এলেন নীলুর ঘরে। চেঁচিয়ে ডাকলেন, নীলু, ও নীলু।

কী হয়েছে কাকু?

না, কিছু না। কিছু না।

ছোট কাকু রুমাল দিয়ে ঘন ঘন ঘাড় মুছতে লাগলেন। তারপর পানির জগটা দিয়ে ঢকঢক করে এক জগ পানি খেয়ে ফেললেন। নীলু খুব কষ্টে হাসি চেপে রেখে বলল, ভয় পেয়েছ কাকু?

ছোট কাকু থতমত খেয়ে বললেন, ভয়? হ্যা তা …। না না ভয় পাব কেন?

নীলু খিলখিল করে হেসে ফেলল। ছোট কাকু গম্ভীর হয়ে বললেন, হাসছ কেন নীলু?

নীলু হাসি থামিয়ে বলল, কাকু তুমি কখনো ভূত দেখেছ? কাকু দারুণ চমকে বললেন, ভূতের কথা এখন থাক নীলু।

এই বলেই তিনি ফস্ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললেন। আর তখনই টেলিফোন বেজে উঠল। কাকু বললেন, হাসপাতাল থেকে টেলিফোন এসেছে রে নীলু। আমি যাই।

নীলু শুনল কাকু বলছেন, হ্যালো, কী বললেন? অবস্থা ভালো না? তারপর? ও আচ্ছা। এ-গ্রুপের রক্ত পাচ্ছেন না? হ্যালো হ্যালো!

এতক্ষণ নীলুর মার কথা মনেই পড়েনি নীলুর। এখন মনে পড়ে গেল। আর এমন কান্না পেল তার হইয়ুর বাবা ঘরে ঢুকে দেখে নীলু বালিশে মুখ গুঁজে খুব কাঁদছে। হইয়ুর বাবা খুব নরম সুরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা?

নীলু কথা বলল না আরো বেশি কাঁদতে লাগল।

কী হয়েছে লক্ষ্মী মা? হইয়ু তোমাকে খামছি দিয়েছে?

নীলু ফোফাতে ফোফাতে বলল, নো।

পেটব্যথা করছে?

উহুঁ।

তবে কী হয়েছে মা?

বলো লক্ষ্মী মা।

নীলু ফোফাতে ফোফাতে বলল, মার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে।

কোথায় তোমার মা?

হাসপাতালে।
নীলু তার মার অসুখের কথা বলল। ভূতটি নীলুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বারবার বলতে লাগল, আহা, বড় মুশকিল তো! কী করা যায়।

সে রুমাল দিয়ে নীলুর চোখ মুছিয়ে দিল।

ব্যাপার দেখে হইয়ু খুব ভয় পেয়ে গেল। সে আর খাটের নীচ থেকে বেরুলই না। একবার মাথা বের করে নীলুকে কাঁদতে দেখে সুড়ৎ করে মাথা নামিয়ে ফেলল নীচে। পুতুল নিয়ে খেলতে লাগল আপন মনে।

হইয়ুর বাবা কিছুতেই নীলুর কান্না থামাতে না পেরে বলল, এক কাজ করা যাক, আমি দেখে আসি তোমার মাকে, কেমন?

আপনাকে দেখে যদি মা ভয় পায়?

ভয় পাবে না। আমি বাতাস হয়ে থাকব কিনা! দেখতে পাবে না আমাকে। বলতে বলতেই সে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। নীলু চোখ মুছে ধরা গলায় বলল, হইয়ু, আমার একা একা একটুও ভালো লাগছে না। তুমি আসো।

হইয়ু হামাগুড়ি দিয়ে খাটের নীচ থেকে বেরুল। নীলু অবাক হয়ে দেখে তার সুন্দর পুতুলটা হইয়ুর হাতে। কিন্তু পুতুলটার মাথা নেই। শুধু শরীর আছে। নীলু ভীষণ অবাক হয়ে বলল, হইয়ু ভাই, আমার পুতুলের মাথাটা কোথায়?

হইয়ু কোনো কথা বলে না। এদিক-ওদিক চায়। নীলু বলল, বলো হইয়ু। ভেঙে ফেলেছ?

না।

তবে কী হয়েছে?

হইয়ু লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলল। কোনোমতে ফিসফিস করে বলল, খুব খিদে লেগেছিল, তাই খেয়ে ফেলেছি। তুমি রাগ করেছ নীলু?

নীলুর অবিশ্যি খুব রাগ লাগছিল। কিন্তু হইয়ুর মতো ভালো ভূতের মেয়ের উপর কতক্ষণ রাগ থাকে। তার উপর নীলু দেখল, হইয়ুর চোখ ছলছল করছে। তাই বলল, বেশি রাগ করিনি, একটু করেছি।

ওমা, এই কথাতেই হইয়ুর সে কী কান্না নীলু তার হাত ধরে তাকে এনে বসাল পাশে। তারপর বলল, কী কাণ্ড হইয়ু বোকা মেয়ের মতো কাঁদে।

এ কথাতেই হেসে উঠল হইয়ু।

খুব ভাব হয়ে গেল তাদের, সেকী হাসাহাসি দুজনের। আর হইয়ুর ডিগবাজি খাওয়ার ঘটনা যদি তোমরা দেখতে নীলুকে খুশি করার জন্যে সে বাতাসের মধ্যে হেঁটে বেড়ালো খানিকক্ষণ। তারপর দুজন দুটি কোলবালিশ নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলল। কিন্তু নীলুর হলো মুশকিল। সে কোলবালিশ দিয়ে হইয়ুকে মারতে যায় আর সে বাতাস হয়ে মিলিয়ে যায়। নীলু রাগ করে বলল, উহুঁ, বাতাস হওয়া চলবে না।

নীলু তাকে দেখাল তার ছবির বই। ফুফু তাকে যে রঙপেন্সিল দিয়েছেন তা দিয়ে সে হইয়ুর চমৎকার একটি ছবি আঁকল। লাল কমল আর নীল কমলের গল্প বলল। তারপর বলল

ভাব ভাব ভাব
ভাব ভাব ভাব
নীল রঙের সিন্ধু
আমি তুমি বন্ধু

অর্থাৎ দুজন সারা জীবনের বন্ধু হয়ে গেল।

হইয়ুর বাবা যখন এলো তখন দুজনে হাত-ধরাধরি করে বসে আছে। হইয়ুর বাবা খুব খুশি হয়ে বলল, নীলু, আমার লক্ষ্মী মা কোথায়?

এই তো, এখানে।

খুব ভালো খবর এনেছি তোমার জন্যে। তোমার মা ভালো হয়ে গেছেন। এখন ঘুমুচ্ছেন দেখে এসেছি।

নীলুর মনে হলো আনন্দে সে কেঁদে ফেলবে। হইয়ুর বাবা আপন মনে খানিকক্ষণ হেসে বলল, তোমার একটা ফুটফুটে ভাই হয়েছে নীলু। সেও শুয়ে আছে তোমার মার পাশে।

নীলুর কী যে ফুর্তি লাগল! এখন সে একা থাকবে না। এখন তার একটা ভাই হয়েছে। ভাইকে নিয়ে নীলু শুধু খেলবে।

দেখতে দেখতে ভোর হয়ে এলো। গাছে কাক ডাকতে শুরু করেছে।

হইয়ুর বাবা বলল, ও হইয়ু, লক্ষ্মী মনা, ভোর হয়ে আসছে। চল আমরা যাই।

কিন্তু হইয়ু কিছুতেই যাবে না। সে ঘাড় বাকিয়ে বলতে লাগল, আমি যাব না। আমি মানুষের সঙ্গে থাকব। আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।

হইয়ুর বাবা দিল এক ধমক।

হইয়ু কাঁদতে কাঁদতে বলল, তেঁতুলগাছে থাকতে আমার একটুও ভালো লাগে না। আমি নীলুর সঙ্গে থাকব, আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।

কিন্তু সকাল হয়ে আসছে। হইয়ুর বাবাকে চলে যেতেই হবে। সে হইয়ুকে কোলে করে নিয়ে গেল আর হইয়ুর সেকী হাত পা ছোঁড়াছুড়ি, সেকী কান্না!

আমি নীলুর সঙ্গে থাকব। আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।

নীলুর খুব মন খারাপ হয়ে গেল। কান্না পেতে লাগল।

তারপর কী হয়েছে শোনো। নীলুর মা কয়েক দিন পর একটি ছোটমতো খোকা কোলে করে বাসায় এসেছেন। মা হাসি মুখে বললেন, ভাইকে পছন্দ হয়েছে নীলু?

হয়েছে।

বেশ, এবার ছোট ভাইকে দেখাও, জন্মদিনে কী উপহার পেয়েছ। যাও নিয়ে। এসো।

নীলু কী আর করে, নিয়ে এলো তার মাথা নেই পুতুল। মা ভাঙা পুতুল দেখে খুব রাগ করলেন। নীলুকে খুব কড়া গলায় বললেন, নতুন পুতুলটির এই অবস্থা! দুদিনেই ভেঙে ফেলেছ? ছি ছি বলো নীলু, কী করে ভেঙেছ বলো?

নীলু কিছুতেই বলল না, চুপ করে রইল। কারণ সে জানে হইয়ু আর হইয়ুর বাবার কথা বললে মা একটুও বিশ্বাস করবেন না। শুধু বলবেন, এইটুকু মেয়ে কেমন বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলছে।

বড়রা তো কখনো ছোটদের কোনো কথা বিশ্বাস করেন না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments