Tuesday, April 23, 2024
Homeরম্য গল্পজীবনের গল্প: কবি ও কবিরাজ

জীবনের গল্প: কবি ও কবিরাজ

জীবনের গল্প

আব্দুল হালিম কবিরাজ একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। সবাই তাঁকে হালিম সাহেব নামে চেনে। হালিম সাহেব অন্য দশজনের মতোই নিজের ক্যারিয়ার বিষয়ে সচেতন এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণ। তাঁর বয়স আটান্ন পার হয়েছে। বছর দুয়েকের মধ্যে অবসরে যাবেন। ইদানীং তিনি লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপ এবং সাহিত্য সাময়িকীতে নিয়মিত গল্প–কবিতা লেখেন। কিন্তু এখনো কোনো বই প্রকাশ করেননি। তাঁর ধারণা, এখন মানুষ বই তেমন একটা পড়ে না।

যুগের পরিবর্তন হয়েছে, এখন সবই ইন্টারনেটে অনলাইনে পাওয়া যায়। এমনকি কিছু অনলাইন পোর্টাল আছে, যেখানে লেখা দিয়েও উপার্জন করার সুযোগ আছে। ধীরে ধীরে হয়তো এমন দিন আসবে, তখন আর বই থাকবে না। লেখক তাঁর লেখা অনলাইনে প্রকাশ করবেন। পাঠক পড়বে আর লেখকের হিসাবে মূল্য সংযোজিত হতে থাকবে।

হালিম সাহেবের লেখালেখি নিয়ে অফিসে অনেক রকম কথাবার্তা হয়। কেউ প্রশংসা করেন, আবার কেউ বলেন, বুড়ো বয়সে ভীমরতি। এ নিয়ে হালিম সাহেবের কোনো মাথাব্যথা নেই। তিনি লিখে যাচ্ছেন। তিনি মনে করেন, অফিসে অনেকেই অনেক কিছু করেন। কই? তাঁদের নিয়ে তো কোনো কথা হয় না!

অফিসার ফখরুল (অনেকে অগোচরে বলেন, ভীমরুল) গোয়েন্দাদের মতো অফিসের সবার ওপর নজর রাখেন। কে কোথায় যান, কে কার সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলেন, কার কার ইন্টারকম ব্যস্ত থাকে, এমনকি ওয়াশরুমের কমন স্পেসে কে কে ইশারায় কথা বলেন, সব তাঁর নজরে থাকে। অফিসের বাইরেও কে কী করেন, না করেন, কে কে একই সময়ে অফিস থেকে বের হয়ে গেলেন, কে কাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গেলেন, কে কখন কাকে কোথা থেকে গাড়িতে তুলে নিলেন, সব তাঁর নখদর্পণে।

সবার দোষ–ত্রুটি ধরা, খোঁচা দিয়ে কথা বলা এবং চিৎকার করে মুখের ওপর উচিত কথা বলতে তিনি কাউকে ছাড়েন না। তাই তাঁকে কেউ ঘাঁটাতে চান না।ফখরুল সাহেব একদিন এমডি মহোদয়কে বললেন, স্যার, হালিম সাহেব অফিসে বসে কবিতা লেখেন।

এমডি সাহেব প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
মানে? সে অফিসের কাজ করে না?

তা করেন, কিন্তু সব সময়ই লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
অফিসের কাজ বাকি থাকে?
না, তা থাকে না।

তো? সমস্যা কোথায়?

কিন্তু স্যার, অফিসের একটা ডেকোরাম আছে না! অফিসে বসে কবিতা লিখবেন!

ঠিক আছে, আপনি যান।

এমডি সাহেব গত দশ বছর এই প্রতিষ্ঠানে আছেন। বয়স পঁয়ষট্টি চলছে, চুক্তির মেয়াদ শেষের পথে। এই বয়সে অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ কম, তবে যত দিন ইচ্ছা এখানে চালিয়ে যেতে পারবেন, যদি মালিকপক্ষ চায়।

সেদিন বিকেলে এমডি সাহেব একটু অবসর পাওয়ায় হালিম সাহেবের কথা মনে পড়ল। বেল টিপে পিয়ন ছেলেটাকে ডেকে বললেন, ‘হালিম সাহেবকে আসতে বলো।’

হালিম সাহেব সালাম দিয়ে রুমে ঢুকলেন। ‘স্যার আমায় ডেকেছেন?’

হ্যাঁ, হালিম সাহেব বসেন। আচ্ছা আপনি তো কবিরাজ? তো কী কী চিকিৎসা দেন?
স্যার, আমি কবিরাজ নই, আমার পদবি কবিরাজ।

কী করে কবিরাজ হলো?

স্যার, আমার দাদা ছিলেন কবিরাজ। তাঁর খুব খ্যাতি ছিল, দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসত। কবিরাজ বাড়ি নামে সবাই চিনত। সেই থেকেই কবিরাজ হয়ে গেলাম।

আপনার দাদা কী কী চিকিৎসা করতেন?

স্যার, সব চিকিৎসাই করতেন।

যেমন?

ধরেন, আপনার পায়ে, গায়ে বা গলায় কাঁটা ফুটেছে, ওনাকে বলে সোজা চলে যাবেন আর পেছনে ফিরে তাকাবেন না, তাহলেই কাঁটা নেমে যাবে।

বলেন কী? ইন্টারেস্টিং!

হালিম সাহেব বলেন, স্যার, একেক রোগের জন্য একেক রকম নির্দেশনা ছিল। তবে হাড় ভাঙলে একধরনের লতা দিয়ে বেঁধে দিতেন, চব্বিশ ঘণ্টা পর খুলে ফেলতেন। হাড় জোড়া লেগে যেত।

তাই নাকি? এ তো ম্যাজিক! উনি ফি কী রকম নিতেন?

স্যার, তিনি কোনো ফি নিতেন না। তবে বলা ছিল, মসজিদে পঁচিশ পয়সার মোমবাতি দিতে হবে। যখন খুশি যেকোনো মসজিদে দিলেই হবে।

আচ্ছা হালিম সাহেব, যাক সে কথা। আপনাকে যে জন্য ডেকেছি, আপনি কবিতা লিখতে শুরু করলেন কবে থেকে?
এই মাস ছয়েক হবে।

তো এই বয়সে এসে কবিতা লেখা শুরু করলেন! রহস্যটা কী?

স্যার, মাস ছয়েক যাবৎ আমি মানুষের চেহারা দেখে বুঝতে পারি, সে কী ভাবছে। তারপর থেকেই এই লেখালেখি শুরু করলাম।এমডি সাহেব মুখে বিরক্তিভাব নিয়ে ভুরু কুঁচকে বিশ্রীভাবে ভেংচি কাটলেন।

স্যার, আপনি ভাবছেন, আমি আপনার সঙ্গে ফাজলামি করছি।

এমডি সাহেব নড়েচড়ে বসলেন, আসলেই তিনি এই কথাই ভাবছিলেন।

এমডি সাহেব বেল টিপে পিয়ন ছেলেটাকে বললেন, দুই কাপ কফি দাও আর কেউ যেন রুমে না ঢোকে।
জি স্যার, বলে পিয়ন ছেলেটা চলে গেল।

এমডি স্যার বললেন, ‘হালিম সাহেব, আপনি আর কী কী বলতে পারেন?’

স্যার, সবকিছু, যেমন, আমি জানি, আপনি আমার বেশ কয়েকটি লেখা পড়েছেন এবং এ–ও জানি যে আপনার ভালো লেগেছে।
আর কী কী?

স্যার, মানুষের ভাবনার কি কোনো শেষ আছে? চাওয়া–পাওয়া, আশা–আকাঙ্ক্ষা, হতাশা এসব আরকি! স্যার, আপনার যদি কিছু জানার থাকে, তবে যাচাই করে দেখতে পারেন।

আচ্ছা হালিম সাহেব, বলেন তো আমার এখন চাওয়ার কী আছে?

স্যার, মানুষের চাওয়ার কোনো শেষ নেই। আর সব চাওয়া কখনো পূরণ হয়, কখনো হয় না। আপনিও তার ব্যতিক্রম নন, তবে এখন আপনি একান্তভাবে চাচ্ছেন, যত দিন আল্লাহ আপনাকে সুস্থ রাখে, তত দিন চাকরিটা চালিয়ে যেতে।

এমডি সাহেব কিছুক্ষণ থ হয়ে রইলেন। এ কথা তিনি কারও কাছে বলেননি। এমনকি স্ত্রী সামিয়ার কাছেও কখনো মুখ ফুটে বলেননি। কথাটা একান্ত তাঁর মনের ভেতর সীমাবদ্ধ।

আচ্ছা হালিম সাহেব, আমার হতাশার কথাটা বলেন তো!

স্যার, এটা শুনলে আপনার হতাশা আরও বাড়তে পারে, তাই না শোনাই ভালো।

এমডি সাহেব কিচ্ছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, হালিম সাহেব, আপনি বলেন, আমি শুনব।

স্যার, আপনার প্রথম সন্তান, ছেলে অনিক এক বছর বয়সে মারা যায়। এরপর তিনটি মেয়ে হলেও আর কোনো ছেলে হয়নি। সেই ছেলে হারানোর ব্যথা আপনি আজও ভুলতে পারেননি। তাই আপনি প্রায়ই ভাবেন, আল্লাহ আমাকে এত ধনসম্পত্তি, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা দিলেন অথচ একটা ছেলে দিলেন না। একটু নিরিবিলি হলেই এই চিন্তা আপনার মাথার ভেতর ঘুরপাক খায়, দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসে।

এমডি সাহেবের মাথার মধ্যে একটা চক্কর দিল। এখন ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে মাথাটা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে বললেন, হালিম সাহেব, আপনি এখন যান।

হালিম সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, স্যার, মাথাটা ঝিমঝিম করছে?

এমডি সাহেব অবাক হয়ে হালিম সাহেবের দিকে তাকালেন। হালিম সাহেব রুম থেকে বের হয়ে এলেন।

– আজাহার খান

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments