Saturday, April 20, 2024
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পকাকতাড়ুয়া - রহস্য গল্প

কাকতাড়ুয়া – রহস্য গল্প

'কাকতাড়ুয়া' রহস্য গল্প

গ্যারি উইলসন পথ হারিয়েছে। ক্লান্তি আর রাগ চরমে উঠেছে ওর। সামনে আরো একটা মাঠ। পেছনে ফেলে আসা মাঠ দুটির মুখ দেখল।

বলে উঠল ও। অসহ্য এই গ্রাম্য এলাকা! অসহ্য লাগে নানুকেও। থাকার আর জায়গা পেল না! বাড়ি ফিরে বুড়িকে শিক্ষা দিতে হবে। কোথায় সেই বাড়ি? কিভাবে ও পথ ভুলে গেল? এ নিয়ে দশবার থামল বেচারা। আজ কম হাটেনি। আশপাশে পাহাড় থাকলে হতো। সেটায় উঠলে হয়তো গোলাপি বাড়িটা দেখা যেত। কিন্ত জায়গাটা সাফোক। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে সবুজ জায়গাগুলোর একটা।

গ্যারির বয়স পনেরো। বেশ লম্বা। ওর বয়সী ছেলেরা সাধারণত এত লম্বা হয় না। সারাক্ষণ চোখমুখ কুঁচকে রাখে। চোখ দুটি দেখলেই বোঝা যায়, ছেলেটা স্কুলের মান্তান। দেহের হালকা-পাতলা গড়নে কিছু যায়-আসে না ওর। এক জোড়া লম্বা হাত পেয়েছে, মুঠো দুটি সাংঘাতিক শক্ত। ও জানে কিভাবে নিজের হাত চালাতে হয়। চায় সব কিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকুক। নিজেই নিজের দেখাশোনা করতে পারে। অন্য কারো প্রয়োজন পড়ে না।

এখন কেউ ওকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে দেখলে হাসাহাসি করবে। অবশ্য ওর হাত জোড়া তো আছেই। যে কাউকে পিটিয়ে ঠাণ্ডা করতে পারবে। কেউ গ্যারি উইলসনকে নিয়ে হাসাহাসি করতে পারে না। ছেলেটা ক্লাসের লাস্ট বয়। কেউ তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করে না। সবাই ওকে এড়িয়ে চলে। তাতে গ্যারির কিছু যায়-আসে না। অন্যদের মেরে মজা পায় ও। কারো টিফিনের টাকা ছিনিয়ে নেয়, আবার কারো বইয়ের পাতা ছিড়ে ফেলে। ভয় দেখিয়ে আনন্দ পায় গ্যারি। সহপাঠীদের ভয়ার্ত দৃষ্টি ভালো লাগে ওর। খানিক পর এক পা গর্তে পড়তেই দুই হাত মেলে চিতপটাং হয়ে গেল ও।

তবে পড়ে না থেকে ঝট করে উঠে দাঁড়াল। পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা পাচ্ছে। মনে মনে একটা অশ্লীল শব্দ বলল। যেঁটা মা শুনলে অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসে। আজেবাজে কথা বলার ব্যাপারে এখন আর নিষেধ করে না মা। ছেলেটা এখন মায়ের সমান লম্বা। তা ছাড়া এই এলাকায় আসার পর নিজের ছেলেকে মা যেন একটু বেশিই ভয় পায়। মাঝেমধ্যে ছেলের সঙ্গে সন্ধিতে আসার চেষ্টা করে।

গ্যারি মায়ের একমাত্র সম্তান। ওর বাবা এডওয়ার্ড উইলসন ব্যাংকে চাকরি করত। একদিন হুট করে মারা যায়। হার্ট অ্যাটাক। গ্যারির সঙ্গে বাবার সম্পর্ক ভালো ছিল না। যখন বুঝল, বাবার মৃত্যুতে ও ঘরের একমাত্র পুরুষ সদস্য, তখন তো খারাপ লাগার প্রশ্নই আসে না।

ও হঠাৎ বুঝতে পারল, বিশাল এক রাস্তা অতিক্রম করেছে। প্রতি কদমে মুখ বিকৃত হচ্ছে ব্যথায়। এরই মধ্যে অস্বস্তিকর এক অনুভূতি ঘিরে ধরেছে। তবে ভয় পাচ্ছে না মোটেও। শুধু একটা ব্যাপারে চিন্তিত-আর কতক্ষণ হাটতে হবে? কতটা পথ পাড়ি দিলে নিজের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাবে? একটা মাছি কানের পাশে বন বন করছে। ওটাকে সরিয়ে দিল গ্যারি।

প্রথমবার নানুর বাসায় ঢোকার কথা মনে পড়ল।

“তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ।” নানু ওকে দেখে মন্তব্য করে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি শুকিয়ে গেছ, এডিথ। ক্লান্ত লাগছে তোমাকে।”

“মা, আমি ঠিক আছি।”

“না। তোমাকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে। কিন্ত এই গ্রামে এই সপ্তাহ থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
গ্রামে এক সপ্তাহ! খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছে গ্যারি। নানুর কথা ভেবে রাগ বেড়ে গেল। এই এলাকা বরাবরই অসহ্য। কিছুই নেই এখানে। চোখের সামনে ভেসে উঠল কংক্রিটের রাস্তা, ট্রাফিক লাইট, হ্যামবার্গার। এই
গ্রামে আছেটা কী?

বুড়ি অবশ্য বলেছিল, অনেক শান্তির জায়গা এটা। বিশুদ্ধ পানি, বাতাস, আরো কত কিছু আছে এখানে! অথচ কোনটা যে রাস্তা, আর কোনটা যে মাঠ তা বোঝার উপায় নেই। সবাই একঘেয়ে জীবন কাটায়। আছে শুধু ফুল, গাছ, পানি, মাছি।
“এখানে সবই আলাদা!”

নানু একবার বলেছিল। “সময় এখানে স্থির। শুধু দাড়িয়ে থেকেই অনেক কিছু কল্পনা করা যায়। মানুষের কোলাহল আর যন্ত্রপাতি আসার আগে দুনিয়াটা কেমন ছিল, তা এই জায়গায় থাকলে বোঝা যায়। এই গ্রাম
এলাকার আলাদা ক্ষমতা আছে। আছে প্রকৃতির জাদু।”

বুড়ির কথা শুনে মুখ বাকাত গ্যারি। এখানে থেকে মহিলা পাগল হয়ে গেছে, গ্রামের আলাদা কোনো ক্ষমতা নেই। লম্বা লম্বা দিনগুলো শেষই হতে চায় না। শুয়ে-বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। কয়েক দিন বাসার বসে থেকে বিরক্ত হয়ে যায় গ্যারি। দুই মহিলার অত্যাচারে পাগল হয়ে যাচ্ছিল। একদিন নানুর সঙ্গে বের হলো। ভাবল, একজনের থেকে কিছুক্ষণ দূরে থাকলে ভালো লাগবে। মাঠে গিয়ে – সিগারেটও টানা যাবে। মায়ের ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করে সিগারেট খাওয়ার মজাই আলাদা।

“সব সময় ফুটপাতের দিকে খেয়াল রাখবে।” মা বলেছিল ফুটপাত ধরে হাটাই সম্ভবত কাল হয়ে দাড়াল। কখন যে পথ হারিয়েছে জানে না। একসময় মনে হলো, পায়ের নিচের মাটি নরম হয়ে আসছে। খানিক পর ওর জুতায় পানি ঢুকল, ভিজে গেল মোজা। মেজাজ খিঁচড়ে গেল। বিচিত্র মুখভঙ্গি করে ও। ঠিক করল, ফিরতি পথ ধরবে। শুরু হলো ক্লান্তিকর পথচলা। ফিরতে গিয়ে দেখে, সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চলে এসেছে। এমনটা তো হওয়ার কথা না!

হাটা থামাল না গ্যারি। পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে শুরু করল। ছোটখাটো একটা জঙ্গলের ভেতর প্রবেশ করল। স্পষ্ট মনে আছে, আসার সময় কোনো জঙ্গল ছিল না। চলতে গিয়ে হাতে কাটা ফুটল। পা কেটে গেল। খানিক পর এক গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পছন্দের জ্যাকেট গেল ছিড়ে। বড় কাপড়ের দোকান থেকে জামাটা চুরি করেছিল। জঙ্গল থেকে বের হতে বেশ বেগ পেতে হলো। এবার আবির্ভূত হলো নতুন বিপদ পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে একটা পুকুর। পানির ওপর একটা গাছের গুঁড়ি। ওটার ওপর দিয়েই যেতে হবে, আরেকটু হলেই পুকুরের ওপাশে চলে যেতে পারত। কিন্তু গাছের গুঁডিটা নড়ে ওকে সরাসরি পানিতে ফেলে
দিল। ভিজে গেল স্টকে থাকা সব সিগারেট।

এরপর… গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল গ্যারি। কারণ, যেটাকে এতক্ষণ মাছি ভেবেছিল, সেটা আসলে মৌমাছি। সেই মৌমাছি গলায় কামড় দিয়েছে।

না! মা আর নানু দুজনকেই এর শান্তি পেতে হবে। সব ওদের দোষ। ওদের কারণেই ওর এই বেহাল অবস্থা। নানুর বাড়িটা আগুনে পুড়িয়ে ফেললে বড় কোনো ক্ষতি হবে না। আর ঠিক তখনই পরিচিত চোখে পড়ল। গোলাপি দেয়াল, ওপরে চিমনি। কিভাবে যেন বাসার কাছে চলে এসেছে! আর একটা মাঠ পেরোলেই বাসায় পৌছে যাবে ও।

কিন্তু এই মাঠ আগের সব মাঠের চেয়ে বড়। সূর্যের তাপও এখন আগের চেয়ে বেশি। নরম মাটির ভেতর একটু পর পর গ্যারির পা ঢুকে যাচ্ছে।

দুটি পায়ের অজন যেন আগের চেয়ে বেশি বেড়ে গেছে। হতচ্ছাড়া মৌমাছিটাও ওকে ছাড়ছে না। বন বন করে ঘুরছে। ওটাকে হাত দিয়ে সরানোর শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। ওর হাত জোড়া দেহের সঙ্গে শিথিল হয়ে ঝুলছে। ১০ মিনিট ধরে হাঁটছে ও, কিংবা তারও বেশি সময় ধরে। নানুর বাসাটা কাছে আসছে না কেনঃ আর এখন এত অস্বাভাবিক গরম কেনো? আগে তো এমন গরম ছিল না।
দুটি ভারী পা, সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা। ওর পা যেন শিকড় গজিয়ে মাটির ভেতর থাকতে চাইছে। আর সামনে এগোতে পারল না। মুখোমুখি একটা লাঠি দেখা যাচ্ছে, মাটিতে পোতা। গ্যারি লাঠিটা কৃতজ্ঞচিতে আকড়ে ধরল। একটা লম্বা বিশ্রাম না নিলেই নয়। অবশ্য এখানকার মাটি অনেক নরম আর স্যাতসেঁতে। বসলে নির্ঘাত প্যান্টসহ নিতম্ব ভিজে যাবে। তার চেয়ে বরং লাঠি আকড়ে ধরে বিশ্রাম নেওয়া যাক। এই তো, খানিক পর মাঠ পেরোলেই বাসা।
আর তারপর…
তারপর…

সূর্ধান্তের পরও ফিরল না গ্যারি। চিন্তিত নানু পুলিশকে ফোন দিল। অফিসার এসে নিখোজ ছেলেটার চেহারা কেমন তা জেনে নিল। পুলিশের অভিযান চলল টানা পাচ দিন। কিন্তু গ্যারির টিকিটির নাগালও পাওয়া গেল না। পুলিশের ধারণা, গ্যারিকে অপহরণ করা হয়েছে। কেউই ওকে দেখেনি। এক পুলিশ মন্তব্য করল, এই এলাকা সম্ভবত গ্যারিকে গিলে খেয়ে ফেলেছে।

পুলিশদের চলে যেতে দেখল গ্যারি। দেখল, ওর মা স্যুটকেস নিয়ে বেরোচ্ছে। ড্রাইভারকে ইপ্সউইচ স্টেশন যেতে বলল মা। মায়ের চোখে পানি দেখে খুশি হলো গ্যারি। মা নিশ্চয়ই ওর জন্যই কাঁদছে। তবে একটা ব্যাপার গ্যারির খুব চোখে লাগল। যখন মা এখানে আসে, তখন ওকে অনেক ক্লান্ত আর অসুস্থ মনে হচ্ছিল। এখন ওকে বেশ সতেজ লাগছে।

গ্যারিকে ওর মা দেখেনি। নানুর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ওর মা লক্ষ করল, আশপাশে কোথাও কোনো কাক নেই। কারণটা বুঝতে পারল খানিক পর। মাঠের মাঝখানে একটা অবয়ব দেখে ভয়ে-সব কাক উড়ে চলে গেছে। সেই অবয়ব একটা লাঠি আকড়ে ধরে আছে। একবার গ্যারির মায়ের মনে হল, অবয়বের পরনে থাকা ছেড়া ফাটা জ্যাকেটটা এর আগেও দেখেছে। গ্যারির এমন একটা জ্যাকেট ছিল মনে হয়। কিন্তু ওর মা নিশ্চিত নয়। থাক, এ নিয়ে কিছু না ভাবাই ভালো। নতুন কাকতাড়ুয়ার পাশ দিয়ে চলে গেল ট্যাক্সিটা।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments