Friday, April 19, 2024
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পঅলৌকিক জল্লাদ ও জীবন্ত কঙ্কাল (২) - মানবেন্দ্র পাল

অলৌকিক জল্লাদ ও জীবন্ত কঙ্কাল (২) – মানবেন্দ্র পাল

oloukik jollad 2

অম্বুজ লাহিড়ির আবির্ভাব

কলকাতায় এসে ঐসব ঘটনা আত্মীয়-বন্ধু কাউকেই বলিনি। কেননা বললে তারা বিশ্বাস করবে না। উল্টে ঠাট্টা-মশকরা করবে। তারা বলবে–এই বিজ্ঞানের যুগে এইসব গাঁজাখুরি ঘটনা ঘটে নাকি?

উত্তর দিতে পারব না। তবে কিনা আমিও বিজ্ঞানের যুগের মানুষ। আর আমি কলকাতার একটি থানার দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার। তা ছাড়া সেইসব ঘটনার একজন সাক্ষীও আছে। সে আমারই মতো কলকাতার আর একজন পুলিশ অফিসার এবং আমার বন্ধু প্রণবেশ। সে তো আমার সঙ্গেই ছিল।

কলকাতায় ফিরে আমরা প্রথমে ঠিক করেছিলাম ঘটনাটা কাগজে বার করব। পুলিশ অফিসারদের অভিজ্ঞতা শুনে নিশ্চয়ই ছাপবে। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছিলাম তাতে অনেকের অনেক অবান্তর প্রশ্নর উত্তর দিতে হবে। তাই মুখে কুলুপ এঁটে থাকাই স্থির করেছিলাম।

শেষ পর্যন্ত প্রণবেশই ঘটনাটা ফাস করে দিল এমন একজনের কাছে যাকে আমি চিনি না, জানি না।

প্রণবেশ একদিন বিকেল বেলায় একজন বেশ ফিটফাট ভদ্রলোককে নিয়ে আমার বাসায় এসে হাজির হলো। বয়েস বছর পঞ্চাশ। নেড়া মাথা। লাল টকটকে মুখ। চোখে সোনালী ফ্রেমের হালকা চশমা। পরনে গেরুয়া আলখাল্লা। নাম অম্বুজবরণ লাহিড়ি। থাকেন সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের কাছে রংপোতে।

একজন রীতিমতো বাঙালি, কিন্তু বহুকাল ধরে রংপোর মতো পাহাড়ী জায়গায় থাকেন শুনে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। তারপর যখন শুনলাম তিনি ঐখানে থেকে প্রেততত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন তখন রংপোর মতো জায়গায় থাকার একটা কারণ খুঁজে পেলাম। আমরা জানি আজকের এই বিজ্ঞানের যুগে থেকেও হিমালয়ের কাছেপিঠে বহু তিব্বতী লামা থাকেন যারা তাদের বিশ্বাস আর ধর্মবুদ্ধি দিয়ে প্রেতচর্চা করেন এবং অশুভ আত্মাকে খুবই ভয় করেন। আর এই অশুভ আত্মার হাত থেকে বাঁচার জন্যে নানা পুঁথিপত্র পড়েন, মন্ত্রতন্ত্র উচ্চারণ করেন। বুঝতে পারলাম অম্বুজবরণ লাহিড়ি সেই কারণেই রংপোর মতো জায়গায় থেকে লামাদের কাছে ঐসব বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করেন।

প্রণবেশ ফট করে আমাকে জিজ্ঞেস না করেই অম্বুজবাবুকে আমাদের অভিজ্ঞতার কথা ফাঁস করে দিয়েছে এটা জেনে আমার মোটেই ভালো লাগেনি। কেননা আমি ভেবে রেখেছিলাম–ঐসব ঘটনা নিয়ে আমিই বই লিখব। এখন যদি অম্বুজবাবু সব জেনে নিয়ে নিজেই আগেভাগে লিখে ফেলেন তাহলে আমার লেখার কোনো দাম থাকবে না।

আশ্চর্য! অম্বুজবাবু আমার মনের কথাটা কেমন করে যেন টের পেয়ে গেলেন। বললেন–সুশান্তবাবু, ঘটনাগুলো আমাকে সবিস্তারে বললে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। কেননা আমার কাজ গোপনে গবেষণা করা। বই ছাপা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার খ্যাতিরও দরকার নেই, টাকারও দরকার নেই।

তার এই কথা শুনে আমি শুধু অবাকই হইনি, লজ্জিতও হয়েছিলাম।

তাকে বসতে বলে স্ত্রীকে চা করতে বললাম। ইতিমধ্যে আমি গত জুলাই মাসে কাঠমাণ্ডুতে আর আমার দেশের বাড়িতে যা যা ঘটেছিল তা বলে গেলাম। দেখলাম তার অনেকটাই তিনি প্রণবেশের কাছে শুনেছেন।

চা আর সুজি নিয়ে আমার স্ত্রী হাসিমুখে এসে দাঁড়ালেন। প্রণবেশ আলাপ করিয়ে দিল।

অম্বুজবাবু হঠাৎ আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, দেশের বাড়িতে আপনাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটা আপনার কিরকম মনে হয়?

স্ত্রী বললেন, সাংঘাতিক। বাড়িতে কাজের জন্যে নেপাল থেকে উনি একটি দুর্ভিক্ষপীড়িতর মতো ছেলেকে নিয়ে এলেন আর সেই ছেলেই ভেল্কি দেখাল। আমি অবশ্য কিছুদিনের জন্যে বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম, সেই সময়ে খালি বাড়িতে নাকি নানারকম ভয়ের কাণ্ড ঘটেছিল।

ছেলেটার কি যেন নাম ছিল?

আমার স্ত্রী বললেন, রাজু সুব্বা।

আচ্ছা, তার গায়ে কখনো হাত দিয়েছিলেন?

গায়ে হাত দেওয়া মানে মারা বলছেন?

না-না, কখনো ছুঁয়েছিলেন?

ম্যাগো! যা ডিগডিগে চেহারা, ছুঁতে ঘেন্না করত। মনে হতো যেন একটা জ্যান্ত কংকাল।

জ্যান্ত কংকাল। অম্বুজবাবু কথাটা নিজের মনে উচ্চারণ করলেন।

ধন্যবাদ। আপনাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই।

আমার স্ত্রী ভেতরে চলে গেলেন।

চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে অম্বুজবাবু বললেন, সুশান্তবাবু, ব্যাপারটার ওপর আমার যথেষ্ট কৌতূহল আছে বলেই আপনাকে কয়েকটি প্রশ্ন করব।

হ্যাঁ, হা, করুন না। তবে ঐ অপ্রীতিকর প্রসঙ্গটা আর মনে আনতেও ইচ্ছে করে না।

অম্বুজবাবু জামার পকেট থেকে মোষের শিঙের তৈরি নস্যির ডিবে বার করে এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, কাঠমাণ্ডুতে বিষ্ণুমতীর তীরে এক তান্ত্রিক একটি ছেলেকে বলি দিতে যাচ্ছিল, আপনি আর আপনার বন্ধু দুজনে মিলে ছেলেটিকে বাঁচান। বলি দিচ্ছিল ঘণ্টাকর্ণের সামনে। আপনারা কি জানতেন নেপালীদের কাছে ঘণ্টাকর্ণ কী ভয়ংকর দেবতা?

হ্যাঁ, শুনেছিলাম জুলাই-আগস্ট মাসে নেপালের পাহাড়ে পাহাড়ে অশুভ শক্তিরা ঘুরে বেড়ায় দানবের মূর্তি ধরে। তাদের সামনে পড়লে মানুষ, জীবজন্তু কারো রক্ষে থাকে না। তাই সেই দানব-দেবতাদের ভয়ংকর মূর্তি গড়ে তাদের পুজো দিয়ে সন্তুষ্ট করে সসম্মানে বিদেয় করা হয়।

ঠিকই জানেন দেখছি। তাহলে সেই দেবতার কাছ থেকে ছেলেটাকে বাঁচানো মানে দেবতার মুখ থেকে গ্রাস কেড়ে নেওয়া?

বিরক্ত হয়ে বললাম, ওসব আমি জানি না। দেবতার মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়াই হোক আর যাই হোক এ যুগে একটা ছেলেকে বলি দেবে তা আমরা দেখেও এড়িয়ে যাব তা হতে পারে না।

অম্বুজবাবু মৃদু হেসে বললেন, আমায় ভুল বুঝবেন না। আমি বলছি না ছেলেটাকে বাঁচিয়ে আপনারা অন্যায় করেছেন। আমি বলতে চাইছি ছেলেটাকে বাঁচাতে গিয়ে আপনারা তান্ত্রিকের কোপ-দৃষ্টিতে পড়েছিলেন। তাই কিনা?

হ্যাঁ। সে তো স্বাভাবিক। বলল প্রণবেশ।

সেই ক্রোধটা আপনাদের ওপর কিভাবে এল?

যে হোটেলে আমরা উঠেছিলাম সেই হোটেলে জং বাহাদুর নামে একটা বয় ছিল। সে বলেছিল অনেক নেপালী গরিব ছেলে ইন্ডিয়ায় চলে যায় সামান্য চাকরির লোভে। আমি তখন আমাদের বাড়ির কাজের জন্যে একটি ছেলে চেয়েছিলাম। জং বাহাদুর যে সত্যিই একটা ছেলে এনে দেবে ভাবতে পারিনি। কিন্তু তার কংকালসার চেহারা দেখে মনে হয়েছিল সে কোনো কাজই করতে পারবে না। একথা শুনে ছেলেটা তখনই এমন সব কাজ করতে লাগল যা দেখে আমরা তাজ্জব।

হ্যাঁ, সেসব আমি শুনেছি।

তখনও কি জানতাম মশাই, ওটা একটা শয়তানের বাচ্চা! আর জং বাহাদুরই সেই তান্ত্রিকের কাছ থেকে ওটাকে নিয়ে এসেছিল আমাদের সর্বনাশ করার জন্যে?

আচ্ছা, ছেলেটা কি কখনো হাসত? জোরে না হোক, মুচকে?

হাসি? আমার স্ত্রী বলে উঠলেন, ঐ মুখে হাসি ফুটবে? মুখ তো নয় একটুকরো লম্বা পোড়া কাঠ।

আচ্ছা, দৌড়-ঝাঁপ করার পর ওকে কখনও হাঁপাতে দেখেছেন?

না মশাই। ওকে যা মনে হয়েছে তা হচ্ছে ও যেন মান্ধাতার আমলের জংধরা একটা যন্ত্র।

মান্ধাতার আমলের জংধরা একটা যন্ত্র! অম্বুজবাবু নিজের মনেই কথাটা উচ্চারণ করলেন।

আচ্ছা, এর আগে আপনি বলেছিলেন ছেলেটা যেন একটা জীবন্ত কংকাল! তাই না?

আমার স্ত্রী হেসে বললেন, হ্যাঁ।

আচ্ছা, ছেলেটা নানাভাবে ভয় দেখাত না?

ভয় দেখাত কী! আমার স্ত্রী বলে উঠলেন–এক দিন সন্ধেবেলায় ও তো পেছন থেকে এসে ওঁর গলা টিপে ধরতে গিয়েছিল। তারপর–

অম্বুজবাবু বাধা দিয়ে বললেন-হা, সেসব প্রণবেশবাবুর কাছ থেকে শুনেছি। আচ্ছা, কাঠমাণ্ডুতে ঐ তান্ত্রিকের ওখানে একটা কংকাল ঝোলানো ছিল। তাই না?

হুঁ।

কিরকম বয়েসের কংকাল?

আন্দাজ চোদ্দ-পনেরো বছর বয়েসের।

এরপর একটু চুপ করে থেকে অম্বুজবাবু বললেন–শেষের দিনের ব্যাপারটা একটু গুছিয়ে বলুন তো।

আমি সব বললাম। আমার স্ত্রী আর প্রণবেশ আমার কথার ফাঁকগুলো ধরিয়ে দিচ্ছিল।

প্রণবেশ বলল, একটা জিনিস বুঝতে পারছি না মিস্টার লাহিড়ি, ঐ কংকালটার সঙ্গে সুব্বার কি কোনো সম্পর্ক ছিল?

অম্বুজ লাহিড়ি আর এক টিপ নস্যি নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, এক সময়ে আমাদের দেশের শক্তিমান কাঁপালিক, তান্ত্রিকরা একের মৃতদেহের মধ্যে অন্যের আত্মা চালনা করতে পারতেন একটা বিশেষ সময়ের জন্যে। আবার এমন তথ্যও পেয়েছি, কেউ কেউ কংকালে একটা বিশেষ সময়ের জন্যে মাংস-চামড়া সৃষ্টি করে তার মধ্যে প্রাণসঞ্চার করতে পারতেন। এই কৃত্রিম চামড়া, মাংস কংকালটাকে কোনোরকমে ঢেকে রাখতে পারত কিন্তু শরীরের যে স্বাভাবিক রূপ, লাবণ্য তা দান করতে পারত না।

এই রকম ব্যাপার আমাদের দেশের রূপকথার কোনো কোনো গল্পে আমরা পাই। এইরকম একটা গল্প ছিল, এক ডাকিনী একটা মরা বাঘের হাড়গোড় জড়ো করে মন্ত্র পড়ে প্রথমে বাঘের পূর্ণাঙ্গ কংকাল তৈরি করল। তারপর মন্ত্র পড়ে তার ওপর মাংস, তার ওপর চামড়া বসিয়ে দিল। তারপর করল প্রাণসঞ্চার। সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা ভয়ংকর রূপ ধরে উঠে দাঁড়াল।

রূপকথার গল্প হলেও এর মধ্যে মন্ত্র-তন্ত্র সাধনার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আমার ধারণা এইরকমই কাণ্ড ঘটিয়েছিল কাঠমাণ্ডুর সেই মহাশক্তিধর তান্ত্রিক। সেই ঝুলনো কংকালটায় প্রাণসঞ্চার করে তাকে-ম্যাজিসিয়ান যেমন কাউকে হিপনোটাইজ করে যেখানে খুশি পাঠাতে পারে, তাকে দিয়ে যা খুশি তাই করাতে পারে, এই তান্ত্রিকও তেমনি ঐ কংকালটাকে জীবন্ত করে দূরে পাঠিয়ে তার অভীষ্ট কাজ সম্পন্ন করে। আপনাকে মারার জন্যে তাই সেই তান্ত্রিক কংকালটাকে–যার নাম দেওয়া হয়েছিল রাজু সুব্বা–পাঠিয়েছিল। কংকালের ওপর কৃত্রিম রক্ত, মাংস, চামড়া বসানো হয়েছিল বলে তার মুখটাকে আপনাদের পোড়া কাঠের মতো মনে হতো। কৃত্রিম সৃষ্টি বলেই তার মুখে হাসি ফুটত না। একই কারণে আপনার ওকে মনে হয়েছিল একটা মান্ধাতার আমলের জংধরা যন্ত্র বলে।

অম্বুজ লাহিড়ি একটু থামলেন। তারপর চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে বললেন, তবে এইরকম জীবন্ত কংকালের শক্তিরও সীমা থাকে। একটা দূরত্ব পর্যন্ত যেতে পারে। তারপর আর পারে না। তাই সেই তান্ত্রিককে দেখা গেছে। আপনাকে মারার জন্যে সুদূর নেপাল থেকে আপনাদের বাড়ির বাগান পর্যন্ত ধাওয়া করে আসতো। সে এখানে না এলে অত দূর থেকে ছেলেটাকে চালনা করা সম্ভব হতো না।

কিন্তু সুব্বা যে এতদিন আমাদের বাড়ি ছিল, তখন তো তান্ত্রিক আসেনি।

নিশ্চয় এসেছিল। আপনারা জানতে পারেননি।

প্রণবেশ বলল, এই জীবন্ত কংকাল কি যেখানে খুশি, যখন খুশি যেতে পারে?

অম্বুজ লাহিড়ি মাথা নাড়লেন। বললেন, না। সবসময়ে সব জায়গায় যেতে পারে না। তা যদি পারত তা হলে তো ঐ তান্ত্রিক অমিত শক্তির অধিকারী হয়ে উঠত। কংকালটাকে দিয়ে যা খুশি তাই করতে পারত। ঈশ্বর এইখানেই নিরীহ মানুষকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।

এই বলে একটু থামলেন। তারপর হেসে বললেন, আজ উঠি। কাল দার্জিলিঙ চলে যাব। একটু কাজ আছে। বলে উঠে পড়লেন।

আমরা ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। আমার স্ত্রী হেসে বললেন, যাক ঐ আপদটার হাত থেকে যে আমরা ঠিক সময়ে রেহাই পেয়েছি এই আমাদের ভাগ্য। যদি ট্রেনে উঠে কলকাতা পর্যন্ত ধাওয়া করে আসত তাহলে কী হতে বলুন তো!

অম্বুজ লাহিড়ি দরজার বাইরে পা রেখেছিলেন, আমার স্ত্রীর এই শেষ কথা শুনে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তিনি আমার স্ত্রীকে বোধ হয় কিছু বলার জন্যে মুখটা ফেরালেন। কিন্তু বললেন না। তবে মুখটা অস্বাভাবিক গম্ভীর দেখাল। মনে হলো যেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।

.

০২.

চাঞ্চল্যকর খবর

দুদিন পরে।

সকাল বেলায় প্রণবেশ এসেছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছেই। আমার স্ত্রী দু স্লাইস করে এগটোস্ট আর চা দিয়ে নিজেও বসেছে। নোটন পড়ছে পাশের ঘরে।

প্রণবেশ অনেকক্ষণ ধরে অম্বুজ লাহিড়ির গুণকীর্তন করে গেল। উনিও নাকি যথেষ্ট ক্ষমতাসম্পন্ন একজন সাধক। আমি অবশ্য এই প্রথম দেখে ততটা মুগ্ধ হতে পারিনি। একটু যেন অহংকারী বলে মনে হয়েছিল। আর খুব সাদাসিধে নয়।

বললাম, চলে যাবার সময় হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও না বলে অমন গম্ভীর মুখ করে কেন গেলেন সেটাই বুঝতে পারছি না। তোমায় কিছু বলেছেন?

প্রণবেশ মাথা নাড়ল। বলল, না। অবশ্য আমারও খটকা রয়েছে। মনে হলো বৌদি ঐ যে বললেন, সুব্বা যদি ট্রেনে উঠে কলকাতা পর্যন্ত আমাদের ধাওয়া করত তাহলে কী হতে বলুন তো? যাক খুব বেঁচে গেছি।এই কথার উত্তর দিতে গিয়েও উনি কেন চেপে গেলেন!

একথা শুনে আমার স্ত্রীর মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বললেন, সুব্বা সত্যিই এখানে এসে পড়বে না তো?

আমি জোরে হেসে বললাম, অত সহজ নয়। এটা কলকাতা শহর। ট্রাম, বাস, ট্যাক্সি রাস্তা কাঁপিয়ে ছুটছে। লোকের ভিড়। এটা কাঠমাণ্ডুর সেই নির্বান্ধব পাহাড়তলি নয়, নির্জন দেশের গ্রাম হরিদেবপুরও নয়। কেউ ওটাকে কোলে করে নিয়ে এসে হাওড়া বা শেয়ালদা স্টেশনে তুলে দিলেও সল্টলেক পর্যন্ত রাস্তা খুঁজে খুঁজে আসা সুব্বা কেন ওর প্রভু সেই তান্ত্রিকটার পক্ষেও সম্ভব নয়। তার ওপর তোমার স্বামী একজন পুলিশ অফিসার মনে রেখো। হাতের কাছে দুটো টেলিফোন। হেড কোয়ার্টারে একটা ফোন করলেই কি বল প্রণবেশ?

প্রণবেশ আজকের কাগজটা পড়ছিল। একটু হাসল। তারপরই হঠাৎ কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, আরে! এ আবার কী?

বললাম, কী? রহস্যজনক খুন?

লক্ষ্য করলাম প্রণবেশের দুচোখ যেন বিস্ময়ে বড়ো হয়ে উঠছে।

খবরটা কি ছাই বলল না।

প্রণবেশ তার উত্তর না দিয়ে শুধু একটা খবরের দিকে আঙুল দেখিয়ে কাগজটা আমার হাতে দিল।

ছোট্ট খবরটা এইরম, গতকাল গভীর রাত্রে চিৎপুর রোড (রবীন্দ্র সরণী) আর বিবেকানন্দ রোডের ক্রসিং-এর মুখে প্রহরারত পুলিশ এক অদ্ভুতদর্শন ছেলেকে একা একা বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে দেখে তার কাছে এগিয়ে যায়। তাকে বার বার ডাকলেও সে সাড়া দেয় না। কাছে যেতেই সে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

পড়তে পড়তে আমার শরীর হিম হয়ে এল। আর আমার স্ত্রী ফ্যাকাশে মুখে শুধু আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

মিনিট পাঁচেক আমাদের মুখে কোনো কথা সরল না। প্রণবেশ আর আমি নিঃশব্দে সিগারেট খেতে লাগলাম।

কিছুক্ষণ পরে প্রণবেশ আমাকে বলল, কি মনে হয়?

বললাম, কনস্টেবলটি যদি বাড়িয়ে কিছু বলে না থাকে তা হলে নিঃসন্দেহে অদ্ভুত ঘটনা। অবশ্য আমার মনে হয় গুরুত্ব দেবার কিছু নেই যতক্ষণ না ঐ অদ্ভুতদর্শন কথাটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে। অদ্ভুতদর্শন বলতে পুলিশটি কী বলতে চাইছে? যদি ওটা নিছক কথার কথা হয় তাহলে nothing serious–মাথা ঘামাবার কিছু নেই। কেননা হয়তো বাইরে থেকে আসা কোনো নতুন ছেলে পথ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে ঘুরছিল।

কিন্তু ঐ যে বারে বারে ডাকলেও সাড়া দেয়নি। কাছে যেতেই অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়–কথাগুলোর মানে কি?

বললাম, ওর মানে সোজা। সম্ভবত গ্রামের ছেলে। গভীর রাত। পথ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে ঘুরছিল। হঠাৎ পুলিশের হাঁকড়ানি শুনে এক দৌড়ে কোনো অন্ধকার গলির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। আর সাড়া দেয়নি? হয়তো ছেলেটা কালা। এছাড়া আর কি হতে পারে?

আমার স্ত্রী ভয়ার্ত গলায় বললেন, হ্যাঁ গো, সুব্বা নয় তো?

আমি জোরে হেসে বললাম, মাথা খারাপ নাকি? সুব্বা আসবে আমাদের গ্রাম থেকে এত দূরে কলকাতায় ট্রেনে চেপে?

সেই সন্ন্যাসীটা ওকে নিয়ে ট্রেনে করে আসতে পারে তো!

তা আসতে পারে কিন্তু আশা করি সল্টলেকে এসে পৌঁছতে পারবে না। কেননা সন্ন্যাসী ঠাকুরকে আমি ঠিকানা দিয়ে নেমন্তন্ন করে আসিনি।

আমার কথা শুনে গৃহিণী অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন।

গৃহিণী নিশ্চিন্ত হলেও প্রণবেশকে দেখে মনে হলো ও যেন তখনও কী ভাবছে।

বললাম, কী হে! কী এত ভাবছ?

ও তার উত্তর না দিয়ে টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিল। তারপর ডায়াল করতে লাগল।

হ্যালো, জোড়াসাঁকো থানা? কমলেশবাবু নাকি? আমি প্রণবেশ কথা বলছি।

হ্যাঁ, ভালো আছি। না, খুন-খারাপির ব্যাপার কিছু নয়। অন্য একটি ব্যাপার। আজকের কাগজে একটা খবর দেখলাম—

হ্যাঁ। আমাদের জগদীশ ঘোষ এরকম কিছু একটা দেখেছিল। ও তো ভয়ে মরে যাচ্ছে। বলছে ভূত ছাড়া কিছু নয়।

ওর কথা বিশ্বাস করেই কাগজে খবর পাঠিয়ে দিলেন?

কী খবর ভাই? এখানে আর-সবাই ওর কথা শুনে খুব ভয় পেয়ে গেছে। ওদের ধারণা অলৌকিক কিছু। শেষে ওদেরই চাপে খবরটা বার করতে হলো।

আপনার কী ধারণা? নিজে চোখে তো দেখিনি। তবে ও যে ভাবে বর্ণনা দিচ্ছে তাতে কিছু যে একটা দেখেছে তাতে সন্দেহ নেই। এতদিন ও এত জায়গায় গভীর রাতে ডিউটি দিয়েছে, কখনও তো এরকম ভয় পায়নি। তা ছাড়া

তা ছাড়া কি বলুন।

তোমার মনে আছে কিনা জানি না বেশ কয়েক বছর আগে রেড রোডে এক পুলিশ অফিসার গভীর রাতে জিপ চালিয়ে যেতে যেতে রাস্তার মাঝখানে কিছু একটা দেখেছিলেন। সে খবর কাগজে ছাপা হয়েছিল। পুলিশের ব্যাপার বলেই ওটা আমি ফাইল করে রেখেছি। ইচ্ছে করলে একদিন দেখে যেও।

তা না হয় দেখব। আপনি একবার জগদীশকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারেন?

তা পারি। কিন্তু তুমি হঠাৎ এ নিয়ে এত ভাবছ কেন? তুমিও কি ঐরকম কিছু দেখেছ?

না। তা নয়। এ নিয়ে পরে কথা বলব।

প্রণবেশ ফোন ছেড়ে দিল।

বললাম, একেবারে জোড়াসাঁকোয় ফোন করে বসলে?

হ্যাঁ। যে দেখেছে সে ঠিক কী দেখেছে তা স্পষ্ট করে জানা দরকার।

মনে হচ্ছে তুমি ব্যাপারটায় খুব গুরুত্ব দিচ্ছ?

এতক্ষণে প্রণবেশ একটু হাসল।

বলল, দেখাই যাক না শ্রীমান জগদীশ কি বলে। কি জানি বাবা, আমার কিরকম ভয় করছে। বলে আমার স্ত্রী উঠে গেলেন।

.

০৩.

জগদীশের কথা

পরের দিন সকালেই জগদীশ ঘোষ এসে হাজির হলো।

আমাদের দুজনকে অ্যাটেনশান হয়ে লম্বা স্যালুট ঠুকে বেচারি বেচারি মুখে দাঁড়িয়ে রইল।

ভেবেছিলাম এইরকম নিরীহ কনস্টেবলদের চেহারা যেমন হয় অর্থাৎ কালোকোলো মোটাসোটা হেঁড়ে মাথা বয়স্ক-এরও সেরকম চেহারা হবে। কিন্তু দেখলাম তা নয়, বেশ স্বাস্থ্যবান, স্মার্ট চেহারা, বয়েসও অল্প।

প্রণবেশ বলল, তুমিই তো জগদীশ ঘোষ?

ইয়েস স্যার।

বোসো। কত দিন পুলিশের চাকরি করছ?

ন বছর পূর্ণ হয়ে পাঁচ মাস।

এখন জোড়াসাঁকোয় পোস্টেড?

ইয়েস স্যার।

এখানে কত দিন এসেছ?

দুবছর তিন মাস।

এর আগে রাতে টহল দিয়েছ কখনো?

অনেক বার।

পরশুদিন রাতে কোথায় তোমার ডিউটি ছিল?

গণেশ টকীজের কাছে নতুন বাজার এলাকায়।

সেদিন তুমি কিছু দেখেছিলে?

ইয়েস স্যার।

একটু গুছিয়ে বলল তো শুনি।

জগদীশ একটু ভেবে নিয়ে বলল, ঐ দিন রাত্রে আমি আর রাম সিং ডিউটি দিচ্ছিলাম। রাম সিং অন্য দিকে গিয়েছিল। আমি একাই বিবেকানন্দ রোডের মুখে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সব দোকানপাট বন্ধ। লোডশেডিং কিনা জানি না, রাস্তায় আলো জুলছিল না। কাছেপিঠে জনপ্রাণী ছিল না। আমার কিরকম ভয় ভয় করল। অথচ বিশ্বাস করুন স্যার, এরকম নির্জন রাতে কতবার তো ডিউটি দিয়েছি, কোনোদিন ভয় পাইনি। ভয় তো একমাত্র ডাকাতদের। তা সঙ্গে বন্দুক আছে, রাম সিং আছে। তবু কেন যেন ভয় পেলাম। মনে হলো খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমি ঘাড় ফিরিয়ে এদিক-ওদিক দেখছি ঠিক তখনই দেখলাম। একটা তেরো-চোদ্দ বছরের ছেলে তরতর করে বিবেকানন্দ রোড ধরে যাচ্ছে। সে দৌড়চ্ছিল না, হাঁটছিল। কিন্তু এত জোর হাঁটা যেন মনে হচ্ছিল দৌড়চ্ছিল।

প্রণবেশ বাধা দিয়ে বলল, কোন দিক দিয়ে এল?

সেটা স্যার লক্ষ্য করিনি। টেরও পাইনি। তবে যখন বিবেকানন্দ রোড ধরে বিধান সরণী মানিকতলার দিকে এগোচ্ছিল তখন অনুমান করি সে স্ট্যান্ড রোডের দিক থেকেই আসছিল।

স্ট্র্যান্ড রোড শুনেই প্রণবেশ আমার দিকে তাকাল। ও বোঝাতে চাইল বোধ হয় স্ট্র্যান্ড রোড মানেই হাওড়ার দিক থেকে।

আমি কোনো মন্তব্য করলাম না।

তারপর?

আমি স্যার, প্রথমে ভেবেছিলাম ভিখিরিদের ছেলেটেলে হবে–যারা ফুটপাথে শোয়। কিন্তু সে যেভাবে জোরে জোরে হাঁটছিল তাতে মনে হলো সে কিছু চুরি করে পালাচ্ছে। তখনই আমি হাঁক দিয়ে দাঁড়াতে বললাম। কিন্তু সে শুনল না। ফের হাঁকড়ে উঠলাম। তবু সে ফিরেও তাকাল না। তখন

ফের বাধা দিয়ে প্রণবেশ বলল, কিরকম চেহারা ছেলেটার?

কী বলব স্যার, বললে বিশ্বাস করবেন না স্রেফ একটা নড়বড়ে কংকালের ওপর যেন চামড়া ঢাকা।

প্রণবেশ আবার আমার দিকে তাকাল।

পরনে কী ছিল?

অন্ধকারে ঠিক দেখতে পাইনি। তবে মস্ত লম্বা ঢিলে একটা ফতুয়া মতো। ড্রেসটাও স্যার অদ্ভুত।

বেশ তারপর?

দু’দুবার দাঁড়াতে বললাম। কিন্তু দাঁড়াল না দেখে রেগে ছুটে গেলাম ওর কাছে। বোধ হয় আমার জুতোর শব্দ পেয়ে ও একবারই শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। স্যার, বলতে গিয়ে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে– তার দুচোখ যেন টর্চের বাম্বের মতো জুলছিল। কোনো মানুষের দৃষ্টি ওরকম হতে পারে না। আর মুখ? স্রেফ একটা ছোট্ট মাথার খুলির ওপর চামড়া বসানো। গাল বলে কিছু নেই। যেন গালের মাংস কেউ চেঁচে তুলে নিয়েছে। কপালটা ঠেলে বেরিয়ে এসেছে।

তারপর?

যদিও আমার হাত ভয়ে কাঁপছিল তবু আমি বন্দুক তুলে ধরে তেড়ে গেলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে ও দৌড় লাগাল। সে দৌড়নো মানুষের মতো দৌড়নো নয়, বাতাসে সাঁতার কাটা। দু মিনিটের মধ্যে সে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল।

এই পর্যন্ত বলে জগদীশ তার বক্তব্য শেষ করল।

মিনিট পাঁচেক আমরা কেউ কোনো কথা বলতে পারলাম না।

একটু পরে প্রণবেশ বলল, আর কিছু লক্ষ্য করেছিলে?

জগদীশ একটু ভেবে বলল, ও যখন দৌড়ে দৌড়ে হাঁটছিল তখন আকাশের দিকে মুখ করে যেন স্যার বাতাস শুঁকতে শুঁকতে এগোচ্ছিল।

আর কিছু?

না স্যার।

আবার যদি ঐরকম কিছু দ্যাখো আমাদের জানাবে।

নিশ্চয় জানাব স্যার। তবে আর যেন ওকে দেখতে না হয়।

প্রণবেশ মুচকে একটু হেসে বলল, ঠিক আছে জগদীশ। তুমি এখন যেতে পার।

জগদীশ আবার আমাদের স্যালুট দিয়ে চলে গেল।

জগদীশ চলে গেলে আমরা দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম।

তারপর প্রণবেশই প্রথম কথা বলল, কী বুঝলে?

রহস্যময়।

যতই রহস্যময় হোক উনি যে রাজু সুব্বাই সে বিষয়ে সন্দেহমাত্র নেই।

কিন্তু ও কী করে কলকাতায় আসবে?

প্রণবেশ হেসে বলল, যেমন করে সুদূর নেপাল থেকে তোমাদের দেশের বাড়ি হরিদেবপুরে এসেছিল।

এখানে আসার উদ্দেশ্য কি?

তাও বুঝতে পারছ না? যে কাজটা ও শেষ করবার আগেই কলকাতায় পালিয়ে এসেছিলে, সেই কাজটি শেষ করার জন্যে।

অর্থাৎ আমাকে মারবার জন্যে?

সে তো আমার চেয়ে তুমিই ভালো করে জানেনা।

কিন্তু রাস্তা খুঁজে খুঁজে এই সল্টলেকে এসে আমায় মারতে পারবে? একটা রোগা-পটকা কংকালের এতখানি ক্ষমতা? না প্রণবেশ, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারব না জগদীশ যাকে দেখেছিল সে সুব্বাই। অনেক কিছু ও বাড়িয়ে বলেছে। আসলে ও একটা রাস্তার ভিখিরির ছেলে ছাড়া আর কিছু নয়।

তাই যদি হয় তাহলে মঙ্গল। ঠিক আছে, এখন আমাদের চোখ রাখতে হবে খবরের কাগজে। গভীর রাতে আর কেউ ওকে অন্য কোথাও দেখতে পায় কিনা।

.

০৪.

আবার জবর খবর

প্রায় প্রত্যেক দিন ভোরে বেড়ানো আমার অভ্যেস। বিশেষ করে এই। সল্টলেকের ফাঁকা এ. জে, এলাকায় বেড়িয়ে খুব আনন্দ পাই।

আমি পুলিশে কাজ করলেও মনটা কবিত্বপূর্ণ। খোলা মাঠ, নীল আকাশ, ঘন মেঘ, ফুলের বাগান আমার খুবই প্রিয়।

যদিও বাসাটা আমার নিজের নয় তবুও আমার স্ত্রী বাড়ির সামনে সামান্য একটু জায়গা ঘিরে ছোট্ট একটি বাগান করেছেন। আর আমি ছাদের কার্নিসে সার দিয়ে সাজিয়ে রেখেছি নানা জাতের বাহারি ফুলের টব। যেমন– জারবেরা, বোগেনভেলিয়া, ফার্ন, গ্রাউন্ড অর্কিড-যার ছোটো ছোটো ভায়োলেট রঙের ফুল।

প্রতিদিন মর্নিং ওয়াক সেরে বাড়ি ঢোকার মুখে একবার করে আলসের ওপর রাখা সার সার টবগুলোকে দেখি। ভারি ভালো লাগে।

ফেরার পথে এক প্রতিবেশী বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় গল্প করতে করতে দেরি হয়ে গেল। তবু বাড়ির গেটে এসে অভ্যাসমতো আলসের দিকে তাকালাম। দেখি একটা টব লাইন ছেড়ে যেন সামনের দিকে সরে এসেছে। একটু অবাক হলাম। ভারী টবটা সরে এল কি করে? এর মধ্যে ঝড়বৃষ্টিও হয়নি যে ঝড়ের ধাক্কায় নড়েচড়ে যাবে।

যাই হোক ঐ সামান্য ব্যাপার নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম ঢুকেই অবাক–এই সাত সকালে প্রণবেশ এসে হাজির হয়েছে।

প্রণবেশ আমার সত্যিকার বন্ধু। আগে দেখাসাক্ষাৎ কম হতো। আমরা যে যার কাজ নিয়ে হিমশিম খাই। অন্য চাকুরেবাবুদের চেয়ে পুলিশ চাকুরেদের অনেক হ্যাপা। কিন্তু জুলাই মাসে দুজনেই এক মাসের ছুটি নিয়ে নেপাল বেড়াতে যাবার পর–আর ঐ রাজু সুব্বার হাঙ্গামাকে কেন্দ্র করে এখন আমাদের সম্পর্ক আরও নিকট হয়েছে। অফ-ডে থাকলে ও প্রায়ই সকালে আমার এখানে চলে আসে। আমিও মাঝে মাঝে ওর বাসায় যাই। কিন্তু এত সকালে ও কখনও আসে না।

কী হে! ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছ দেখছি! হেসে বন্ধুকে স্বাগত জানাই।

কিন্তু প্রণবেশ হাসল না। বেশ আদেশের সুরেই বলল, চুপটি করে এখানে বোসো। কথা আছে। তারপর আমার স্ত্রীকে বলল, বৌদি, এবার আমাদের চা দিন।

আমি মজা করে বন্ধুর অনুমতি নিয়ে বাইরের প্যান্ট-জামা ছাড়তে কয়েক মিনিটের জন্যে ভেতরে চলে গেলাম। পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরে, মুখ ধুয়ে যখন বাইরের ঘরে এসে বসলাম তখন দেখি গৃহিণী টোস্ট আর চা নিয়ে হাজির।

সবেমাত্র টোস্টে আরাম করে কামড় দিয়েছি অমনি প্রণবেশ ওর ব্রিফকেস থেকে সেদিনের কাগজখানা বের করে মাঝের পাতায় একটা খবরে দাগ দিয়ে গম্ভীর মুখে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।

কাগজটা নিয়ে ঝুঁকে পড়লাম খবরটার দিকে। খবরটা এইরকম–

জীবন্ত কংকালের পুনরাবির্ভাব

গতকাল রাত দুটোর সময়ে দুজন সাংবাদিক খবরের কাগজের অফিসের ডিউটি সেরে গাড়িতে বাড়ি ফিরছিলেন। নিঝুম রাত। জনশূন্য রাজপথ। শেয়ালদা ফ্লাইওভারের কাছে আসতেই তাদের চোখে পড়ে একটো তেরো চোদ্দ বছরের কংকালসার ছেলে আকাশের দিকে মুখ করে বেলেঘাটা মেন রোডের দিকে জোরে হেঁটে চলেছে। সে হাঁটা সাধারণ মানুষের হাঁটার মতো নয়–যেন শূন্যে পা ফেলে দৌড়নো। গায়ে ছিল কালো রঙের হাঁটু পর্যন্ত লম্বা একটা ফতুয়া। তার মাথাটা ছোটো। নারকেলের মতো। খাড়া খাড়া পাতলা চুল। কৌতূহলী সাংবাদিকরা তখনই সোজা না গিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে বেলেঘাটা মেন রোডের দিকে চালান। গাড়ি যতই ছেলেটার কাছাকাছি হচ্ছিল, আশ্চর্যজনকভাবে ছেলেটা ততই দূরে সরে যাচ্ছিল। তারপরই ছেলেটা অন্ধকারে যেন মিলিয়ে গেল। ইতিমধ্যে তারা ফ্ল্যাশে ছেলেটার অনেকগুলো ছবি তুলেছিলেন। কিন্তু অবাক কাণ্ড–একটা ছবিও ওঠেনি।…

খবরটা পড়ে আমার সমস্ত শরীর হিম হয়ে গেল। বুঝতে বাকি রইল না ঐ জীবন্ত কংকালটি আর কেউ নয়নেপালের সেই রাজু সুব্বাই, যে আমার দেশের বাড়িতে বার বার আমাকে মারবার চেষ্টা করেছিল। এখন সে আমাকে মারবার জন্যেই কলকাতায় এসে পড়েছে।

এখন বুঝতে পারছ কী সাংঘাতিক বিপদ এগিয়ে আসছে? প্রণবেশ আমার ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল।

আমার বেশি কথা বলার শক্তি ছিল না। শুধু মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম।

কিন্তু

প্রায় ধমক দিয়ে প্রণবেশ বলল, এখনও কিন্তু? এখনও সন্দেহ আছে নাকি?

আমি কোনোরকমে জুড়নো চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, সে কথা বলছি না। বলতে চাইছি–যে হাওড়ার দিক থেকে স্ট্রান্ড রোড, পোস্তা হয়ে চিৎপুর ক্রস করে বিবেকানন্দ রোড ধরে এগোচ্ছিল, সে হঠাৎ শেয়ালদা ফ্লাইওভারের কাছে এল কেন?

প্রণবেশ বলল, আমার ধারণা ও সল্টলেকে পৌঁছুবার ঠিক পথটা ধরতে পারছে না। একটা জিনিস লক্ষ্য কোরো, জগদীশ ঘোষও বলেছিল আকাশের দিকে মুখ করে ছুটছিল। তার মানে কি? নিশ্চয় আকাশের শোভা দেখতে দেখতে যাচ্ছিল না।

আমি বললাম, তা অবশ্যই নয়।

তাহলে?

আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, বুঝতে পারছি না।

প্রণবেশ বলল, আমার ধারণা ও বাতাসে তোমার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে যাচ্ছিল।

কিন্তু দেশের বাড়িতে তো ও বেশ কিছুদিন ছিল। কই তখন তো ওরকম করে চলেনি?

প্রণবেশ বলল, ভুলে যাচ্ছ বন্ধু, তখন তোমায় খোঁজার দরকার হয়নি। তুমি ছিলে ওর নাগালের মধ্যে।

আমি চুপ করে রইলাম। ভাবছিলাম প্রণবেশের কথা যদি ঠিক হয় তাহলে আমরা কি সত্যিই কলকাতা শহরে আছি, না কোনো অলৌকিক জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছি?

প্রণবেশ স্থির বিশ্বাসের সঙ্গে বলল, হাওড়ার দিক থেকে সল্টলেকে আসার অনেকগুলো পথ আছে। তার মধ্যে বিবেকানন্দ রোড, মানিকতলা হয়ে ভি. আই. পি. রোড ধরেও যেমন আসা যায় তেমনি শেয়ালদা উড়ালপোলের ক্রসিং থেকে শেয়ালদার পাশ দিয়ে বেলেঘাটা রোড দিয়ে ভি. আই. পি. রোড ধরেও আসা যায়। মনে করে দ্যাখো এই কদিনের মধ্যে তুমি নিশ্চয় ঐ দুটো পথ দিয়েই যাতায়াত করেছ।

বললাম, তা করেছি। অনেক বারই করেছি।

ব্যস্। তা হলে তো অংক মিলেই গেল।

আমি খানিকটা হতাশার সুরে বললাম, এ কথাটাই তাহলে তুমি আমায় বোঝাতে চাচ্ছ–সেই তান্ত্রিক আমাকে এখনও ছাড়েনি। রাজু সুব্বাকে লেলিয়ে দিয়েছে কলকাতাতেও। সে পথ না চিনলেও শিকারী কুকুরের মতো বাতাসে আমার যেটুকু গন্ধ এখনও মিশে আছে তাই শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে আসছে।

প্রণবেশ গম্ভীরভাবে বলল, হ্যাঁ।

আমি অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট ধরালাম।

কিন্তু—একটা কথা

বলো।

হরদেবপুর থেকে ও কলকাতায় এল কি করে? ট্রেনে?

প্রণবেশ হেসে বলল, ট্রেনে যদি আসতে পারতো তাহলে সেদিনই ছুটে এসে ট্রেনে উঠে পড়তো। তোমার মনে আছে কি অম্বুজ লাহিড়ি একটা কথা বলেছিলেন, আমরা যাদের অলৌকিক জীব বা ভূতজাতীয় কিছু বলি তারা অনেক কিছু করতে পারলেও সব কাজ তারা করতে পারে না বা সব জায়গায় তারা যেতে পারে না। কিছু বাধা থাকেই। এটাই রক্ষে। তাই অন্তত ট্রেনে, বাসে, ট্যাক্সিতে সাধারণ মানুষের মতো এরা উঠতে পারে না। এরা পথ ধরেই আসে। অবশ্যই সে পথ নির্জন হওয়া চাই। আর চাই অন্ধকার রাত।

এইখানে আমার একটা পয়েন্ট জানার আছে।

প্রণবেশ বলল, কি তোমার পয়েন্ট বলো।

শুধু রাত্রেই যদি ও হেঁটে আসে তা হলে দিনে কোথায় থাকে?

প্রণবেশ চমকে উঠে বলল, দারুণ পয়েন্টটা তো তুমি তুলেছ! এটা তো আমার মাথায় আসেনি!

বললাম, বুঝতেই পারছি একটা অদ্ভুত ধরনের বিপদ এসে পড়েছে। এখন দেখতে হবে সুব্বা দিনের বেলায় কোথায় থাকে। নিশ্চয় ভি. আই. পি. রোড দিয়ে বেলেঘাটা মেন রোডে ভালো করে খুঁজলে তার সন্ধান পেয়ে যাব।

কাজেই চলো এখুনি আমরা জিপটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।

প্রণবেশ বলল, খুব ভালো কথা বলেছ। কিন্তু তার আগে আমাদের একটা কাজ করতে হবে। লোকে গাঁজাখুরি ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেবে এই ভয়ে এখন আর মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলে চলবে না। দুদিন কাগজে তো খবর বেরিয়েই গেছে। এবার সব থানায় পুলিশদের হুঁশিয়ার করে দিতে হবে। সব আগে লালবাজারকে জানাতে হবে। আর যে কাগজে এই খবরগুলো ছাপা হয়েছে তাদের কাছ থেকে জানতে হবে লোকে খবরটা পড়ে কিছু বলছে কিনা। অর্থাৎ সারা কলকাতা শহরে একটা হৈচৈ তুলতে হবে। আর সেটা করতে হবে আজ দুপুরের মধ্যেই। কেননা আর সময় নেই। এই বলে প্রণবেশ উঠে পড়ল।

বললাম, কখন আসছ তাহলে?

প্রণবেশ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, বেলা একটায়।

ঠিক আছে। আমি রেডি হয়ে থাকব।

প্রণবেশকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ফিরে আসছি, ছাদের কর্নিসের দিকে লক্ষ্য পড়ল। চমকে উঠলাম–সেই টবটা লাইন থেকে আরও খানিকটা বেরিয়ে এসেছে।

.

০৫.

জীবন্ত কংকালের সন্ধান

কাঁটায় কাঁটায় বেলা একটার সময়ে প্রণবেশ জিপ নিয়ে হাজির হলো। আমিও রেডি হয়ে ছিলাম। বেরোতে যাচ্ছি, প্রণবেশ বলল, দাঁড়াও একটা ফোন করে নিই।

বলে যে দুটো কাগজে দুদিন খবরটা বেরিয়েছিল তার একটাতে ফোন করল। রিং হতেই প্রণবেশ নিউজ এডিটার পরিতোষ শীলকে চাইল।

পরিতোষ প্রণবেশের অনেক দিনের চেনা। প্রণবেশের গলা পেয়ে পরিতোষ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।

কি খবর ও. সি. সাহেব? হঠাৎ খবরের কাগজে হামলা? বেয়াড়া কোনো খবর ছেপেছি নাকি?

ঠিক ধরেছ। হেসে বলল প্রণবেশ, আজকাল গাঁজায় দম দিয়ে খবর ছাপছ নাকি?

না, এখনও গাঁজার তেমন আমদানি হয়নি। তবে শীগগির হবে।

কিরকম?

সামনের সপ্তাহে বারাণসীতে কি এক মহাযোগে পুণ্যস্নান আছে। দলে দলে সাধু-সন্ন্যাসী আসতে শুরু করবে। আর তখনই তাদের গাঁজার ধোঁওয়ায় সারা কলকাতা অন্ধকার হয়ে যাবে।

পরিতোষের রসিকতায় গুরুত্ব না দিয়ে প্রণবেশ বলল, দুদিন ধরে হঠাৎ ঐসব ভুতুড়ে ব্যাপার ছাপতে আরম্ভ করলে কেন? বেশি কাগজ বিক্রির লোভে?

ভুতুড়ে ব্যাপার! ও জীবন্ত কংকালের কথা বলছ তো?

হ্যাঁ।

কি জানি যে খবর আমরা পেয়েছি তা শুধু অবিশ্বাস্য নয়, অকল্পনীয়। আমাদের স্টাফ রিপোর্টার নিজে চোখে দেখেছে। তাও একজন নয় দুজন। আর অবাক কাণ্ড–এতগুলো ছবি তুলল কিন্তু একটা ছবিও উঠল না।

প্রণবেশ হেসে বলল, কেন বলো তো?

পরিতোষ চাপা গলায় বলল, স্টাফ রিপোর্টারদের মতে চামড়া ঢাকা কংকলটার নাকি শরীর বলে কিছু ছিল না। নইলে একটি ছবিও উঠত না?

প্রণবেশ বলল, তা খবরটা দেখে পাবলিক কি বলছে?

উঃ! আর বোলো না। টেলিফোনের পর টেলিফোন আসছে ঘটনাটা কতখানি সত্যি তা জানতে।

উত্তর কী দিচ্ছ?

বলছি প্রত্যক্ষদর্শীরা যা দেখেছে তাই খবর করে দিয়েছি। ওরা জানতে চায় জীবন্ত কংকালটা কোন দিকে যাচ্ছে। সেটা আর আমি কি করে বলব বলো। আমার সঙ্গে তো কংকালটার কথাবার্তা হয়নি। চোখে দেখারও সুযোগ হয়নি।

কোথায় যাচ্ছে সে খবরটা হয়তো তোমাকে দিতে পারব।

অ্যাঁ! বল কী! ঠাট্টা করছ না তো?

না। ঠাট্টা করলে তোমায় ফোন করে প্রসঙ্গটা তুলতে যাব কেন? দিন দুই অপেক্ষা করো। চমকে ওঠার মতো খবরটা তোমাকেই আগে দেব।

বলে প্রণবেশ রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।

কী ব্যাপার? হঠাৎ খবরের কাগজে ফোন?

জেনে নিলাম কলকাতার মানুষ খবরটা জেনেছে। এটাই চাইছিলাম।

প্রণবেশ আর আমি জিপ নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। প্রথমে লালবাজার। সেখানে পুলিশের বডোকর্তারা আমাদের মুখে নেপাল থেকে হরদেবপুর পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা শুনে অবাক। তারা কখনোই এ সব ঘটনা বিশ্বাস করতেন না। গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু যেহেতু আমরা দুজনেই পুলিশে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছি, যেহেতু আমরা দুজনেই প্রত্যক্ষদর্শী আর দুদিন দুদুটো নামী কাগজে তিনজন প্রত্যক্ষদর্শীর খবর ছাপা হয়েছে সেজন্যে তারা ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে পারলেন না। এটা যে সত্যিসত্যিই ভৌতিক বা অলৌকিক ব্যাপার তা পুরোপুরি না মানলেও জীবন্ত কংকালটাকে খুঁজে বের করবেনই সে আশ্বাস দিলেন। এবং আমাদের সামনেই কলকাতার সমস্ত থানাকে বিশেষ করে বেলেঘাটা আর উল্টোডিঙ্গি থানাকে জানিয়ে দিলেন রাস্তায় সতর্ক দৃষ্টিতে যেন লক্ষ্য করা হয় ঐরকম কংকাল জাতীয় কিছু দেখতে পাওয়া যায় কিনা।

আমরা দুজনেই খুশি হলাম। অলৌকিক হোক বা না হোক দায়িত্বটা এখন শুধু আমাদের দুজনের রইল না। পুলিশ টেক-আপ করেছে। কাজেই আমরা অনেকটা নিশ্চিন্ত।

এছাড়া পাবলিকও কাগজ-মারফৎ জেনে গেছে ব্যাপারটা। কাজেই কোথাও যদি জীবন্ত কংকালটাকে কেউ দেখতে পায় তাহলে তার উপযুক্ত ব্যবস্থা জনসাধারণই নেবে কিংবা থানায় জানিয়ে দেবে। আমাদের আর ভাবতে হবে না।

পাবলিক যে এই ব্যাপার নিয়ে কতটা মেতে উঠেছে, বেলেঘাটা মেন রোডে ঢুকতেই তা বুঝতে পারলাম।

যদিও তখন বেলা প্রায় তিনটে রাস্তায় লোকজন কম তবু দুধারের ফুটপাথে লোকের জটলা। বোঝা গেল আজকের কাগজেই খবরটা পড়ে তারা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। একজন বলছে, সব গাঁজা। খবরের কাগজগুলো পর্যন্ত আজগুবি খবর ছড়াচ্ছে।

আর একজন প্রতিবাদ করে বলছে, এর আগেও, অন্য কাগজে এইরকম খবর বেরিয়েছে। বাজে কথা হলে দুদুটো বড়ো কাগজে এরকম খবর ছাপা হয়?

আমরা জিপটা থামিয়ে নেমে পড়লাম।

পুলিশ দেখে ওদের কথাবার্তা থেমে গেল। প্রণবেশ এগিয়ে গিয়ে বলল, আপনারা যা নিয়ে আলোচনা করছেন, আমরাও সে বিষয়ে খোঁজ নিতে বেরিয়েছি। লালবাজার সমস্ত থানাকে জানিয়ে দিয়েছে রাতে তোক দিনে হোক এইরকম কাউকে দেখলে তখনই, যেন ধরবার চেষ্টা করে।

পুলিশের মুখ থেকে এই কথা শুনে ওরা খুব উৎসাহ পেল। বলল, আমরা স্যার, ঠিক করেছি রাতের বেলা রাস্তায় রাস্তায় পাহারা দেব।

ইতিমধ্যে পুলিশ দেখে আরও লোক জড়ো হয়ে গেছে।

প্রণবেশ বলল, একটা জিনিস মনে রাখবেন–ঐ যার কথা বলা হচ্ছে সে আপনাদের বেলেঘাটায় থাকতে আসেনি। আমরা জেনেছি তার লক্ষ্য সল্টলেক। বেলেঘাটা রোড ধরে ভি. আই. পি. রোডের দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু গভীর রাত ছাড়া সে এগোতে পারে না। কাল রাতে এই রাস্তা দিয়ে পাস করেছে।

ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, আমরা দুটো মোটরবাইক নিয়ে ভি. আই. পি. রোডটা দেখে আসতে পারি।

বললাম, সে তো আমরাও জিপে করে যেতে পারি। তা নয়। দিনের বেলায় সে এগোয় না। কাজেই এখন এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে।

এ কথা শুনে সবাই যেন চনমন করে উঠল।

তা হলে স্যার, আমরা খুঁজতে বেরিয়ে পড়ি?

এমন সময় ভিড়ের ভেতর থেকে একটা অল্পবয়সী ছেলে বলে উঠল, একটু আগে একজনকে একটা ভাঙা পুরনো বাড়ির কার্নিসের ওপর শুয়ে থাকতে দেখেছি।

প্রণবেশ চমকে উঠে বলল, কিরকম দেখতে?

ছেলেটা বলল, ভালো করে দেখতে পাইনি। শুধু দুটো সরু সরু কালো পা দেখতে পেয়েছি। ভাবলাম নিশ্চয় কোনো পাগল।

প্রণবেশ ব্যস্ত হয়ে বলল, কতক্ষণ আগে দেখেছ?

আধঘণ্টা আগে।

জায়গাটা কোথায়?

আর একটু আগে। শেতলা মন্দিরের কাছে।

তুমি আমাদের সঙ্গে জিপে উঠে এসো।

ছেলেটাকে জিপে তুলে নিয়ে আমরা শেতলা মন্দিরের দিকে চললাম। আর একদল ছেলে-ছোকরা লাঠি, টাঙ্গি হাতে নিয়ে হৈ হৈ করে আমাদের পিছনে ছুটে আসতে লাগল।

শেতলাতলা ওখান থেকে বেশি দূরে নয়। আলোছায়া সিনেমা হলের কাছেই। তার একটু দূরেই ভি. আই. পি. বোড় চলে গেছে উল্টোডিঙ্গি। আর বাইপাস পার হলেই সল্টলেক। ইস্টার্ন বাইপাসকে ডান দিকে ফেলে যে রাস্তাটা সেটাই হলো সল্টলেকে ঢোকার প্রধান পথ।

ছেলেটা বললে, এইখানে–সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামালাম। জায়গাটা আলোছায়া সিনেমা হল আর শেতলাতলার মাঝখানে। এখানে মেন রোড থেকে বাঁ দিকে একটা রাস্তা চলে গেছে। আর সেই রাস্তার সামনেই একটা বিরাট তিনতলা বাড়ির জীর্ণ কংকাল দাঁড়িয়ে। ছেলেটার পিছু পিছু আমরা এগিয়ে চললাম। ছেলেটা বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল। ভাঙা পাঁচিলঘেরা কম্পাউন্ডের মধ্যে বাড়িটা। একতলার জানলা-দরজা সব উধাও। দোতলার বিবর্ণ জানলা যে কটা সামনে থেকে দেখা গেল সবই বন্ধ। তিনতলার ওপর বিরাট লম্বা ছাদ। ছাদের আলসেতে ছোটো ছোটো গাছ, ঘাস গজিয়েছে। বাড়ির পিছনে মস্ত একটা বটগাছ। বোঝা যায় বাড়িটার সামনে-পিছনে যতই আধুনিকতার প্রলেপ দেওয়া হোক না কেন জায়গাটা আসলে খুবই পুরনো।

ছেলেটার সাহস আছে বলতে হবে। কিংবা জীবন্ত কংকাল সম্বন্ধে কোনো খবর রাখে না। সে জানে শুধু একটি পাগলই বোধ হয় ঐ পাঁচিলের ওপর শুয়ে আছে। পাগল না হলে কেউ সরু পাঁচিলের ওপর শুতে পারে?

ছেলেটা দিব্যি কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকে পড়ে ছাদের দিকে তাকাল। তারপর হতাশ হয়ে বলল, নাঃ, নেই। চলে গেছে। একটু আগেও ছিল।

চলে গেছে? প্রণবেশ যেন চুপসে গেল।

ছেলেটা বলল, তাই তো মনে হচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি না। তবে কাছেই কোথাও আছে–নিশ্চয় আছে। একটা চিমসে গন্ধ পাচ্ছেন না? গন্ধটা আমি তখনও পেয়েছিলাম।

সত্যিই একটা চিমসে গন্ধ গলিতে ঢোকার পর থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল।

প্রণবেশ বলল, ছাদে ওঠা যাবে না?

ছেলেটা মাথা দুলিয়ে বলল, যাবে।

তবে চলো।

এই সময়ে পেছনে যারা লাঠিসোটা নিয়ে আসছিল তারা হল্লা করতে করতে এসে পড়ল। সত্যি কথা বলতে কি বাড়িটার ভেতরে ঢুকতে অন্তত আমার খুব ভয় করছিল। এখন এত লোক দেখে সাহস হলো।

পেছনের লোকগুলো চেঁচিয়ে উঠল, আমরাও ওপরে উঠব।

আমরা ওদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে সবে মাত্র ভেতরের দিকে পা বাড়িয়েছি এমনি সময় তেতলার ছাদ থেকে কি যেন লাফিয়ে পড়ল বটগাছের ওপর।

এক মুহূর্তের জন্যেই দেখতে পেয়েছিলাম বস্তুটাকে। কোনো কিশোরও নয়, জীবন্ত কংকাল নয়, শুধু লম্বা কালো মতো একটা কিছু–যা মানুষ নয়, বাঁদর বা অন্য কোনো জীবের সঙ্গেও কিছু মাত্র সাদৃশ্য নেই। সেই বস্তুটা গাছের ওপর লাফিয়ে পড়া মাত্র–সমস্ত গাছটা ঝকানি খেল। কতখানি ভারী বস্তুর ধাক্কা খেলে অত বড়ো গাছটা অমন নড়ে উঠতে পারে ভেবে অবাক হলাম। তবু কী বিশ্বাস করতেই হবে বস্তুটা আমাদের সেই চেনা তেরো-চোদ্দ বছরের রাজু সুব্বারই জীবন্ত কংকাল? অসম্ভব।

এদিকে বস্তুটাকে যারা গাছে লাফ দিতে দেখেছে তারা হৈ হৈ করে বটগাছের নিচে ছুটে গেল। কিন্তু ঝাড়া এক ঘণ্টা ধরে সবাই মিলে খুঁজেও তাকে পাওয়া গেল না–চোখের দেখাও নয়।

.

০৬.

দুর্ভেদ্য দুর্গ

বাড়িতে ভয়ের একটা কালো পর্দা নেমে এসেছে। নোটনের মা সব শুনেছেন। তিনি শুধুই বলেন, কি হবে গো? রাজু শেষ পর্যন্ত কলকাতাতেও ধাওয়া করে এল? তাহলে কি আমাদের বাড়িও খুঁজে পাবে?

এর উত্তর আমি আর কি দেব? যে ভি. আই. পি. রোড পর্যন্ত আসতে পেরেছে সে যে এখানেও আসবে না তা কি করে বলি? তাই চুপ করে থাকি।

মনে মনে এও বুঝেছি, যে আসছে সে এখন আর আমাদের আগের রাজু সুব্বা নয়, যেন অন্য কেউ—আরও হিংস্র আরও ভয়ানক।

সকালবেলাতেই প্রণবেশ চলে এসেছে আমাদের বাড়ি। লক্ষ্য করছি ক্রমশই দুর্ভাবনায় ওর মুখের ভাব বদলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার চেয়ে যেন ওরই ভয় বেশি। ওই যেন আমাকে বাঁচাবার সব দায়িত্ব নিয়েছে। আর আমি? আমি যে কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। বন্ধুর ওপরই সব ছেড়ে দিয়ে বসে আছি।

প্রণবেশ সকালে এসেই দার্জিলিঙে অম্বুজ লাহিড়িকে ফোন করেছিল। উনি এখন দার্জিলিঙে রয়েছেন। কিন্তু উনি কোথায় বেরিয়েছেন। ঘণ্টাখানেক পরে আবার ফোন করা হবে।

অম্বুজবাবুকে যে এই পরিস্থিতিটা এখনই জানানো উচিত এটাও আমার মাথায় আসেনি। আমি পুলিশ অফিসার। তাই বোধ হয় ভেবে নিয়েছি, লালবাজার যখন দায়িত্ব নিয়েছে তখন আর ভাবনা নেই। ওরাই আমাকে বাঁচাবে। একটা অতি সত্য ব্যাপার যেন বুঝেও বুঝছি না যে, এটা খুনে ডাকাতের ব্যাপার নয় যে পুলিশ ব্যবস্থা করবে। এ যে কী বিস্ময়কর ব্যাপার তা তো কালকেই স্বচক্ষে দেখলাম। ভাঙা বাড়ির তিনতলার পাঁচিলে শুয়ে থাকতে না দেখলেও ছাদ থেকে বটগাছে লাফিয়ে পড়তে যাকে দেখলাম সে কী আমাদের গ্রামের বাড়ির সেই রাজু সুব্বাই! রাজুও ছাদের পাঁচিলের ওপর দিয়ে হাঁটত। ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আমগাছের ডাল ধরে ঝুলত ঠিকই কিন্তু সে যেন আমার ছেলে নোটনেরই বন্ধু। কিন্তু কাল যাকে মুহূর্তের জন্যে দেখলাম? তার তো মানুষের আকৃতিও নয়। চার ফুট লম্বা কালো একটা বস্তু। অথচ তারই ভারে অত বড়ো বটগাছটা কেঁপে উঠেছিল।

আবার গত দুদিন ধরে গভীর রাতে রাস্তায় যাকে দেখা গিয়েছিল তার মানুষের আকৃতি ছিল। তার বর্ণনা শুনে মনে হয়েছিল সে রাজু সুব্বাই।

তাহলে কাল দুপুরে যাকে দেখা গেল সে কি অন্য কিছু? আর অন্য কিছুই যদি হয় তাহলে সেটা কী?

আশ্চর্য! এই সব প্রশ্ন যখন প্রণবেশকে করেছি ও কোনো উত্তরই দেয়নি। শুধু ওর কপালে দুশ্চিন্তার একটার পর একটা রেখা ফুটে উঠেছিল।

প্রণবেশ এতক্ষণ টেলিফোনের সামনে বসে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছিল। এবার ঘড়িটা দেখল।বোধহয় এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। ও টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াল আর তখনই টেলিফোনটা বেজে উঠল। তাড়াতাড়ি রিসিভারটা তুলে নিয়ে সাড়া দিল, হ্যালো! হ্যাঁ, আমি প্রণবেশ। এক ঘণ্টা আগে আপনাকে ফোন করেছিলাম। তারপর ও সমস্ত ঘটনা বলে গেল।

টেলিফোনের শব্দ শুনে আমার স্ত্রীও এসে দাঁড়িয়েছেন, মুখে-চোখে এক রাশ উদ্বেগ নিয়ে।

দার্জিলিঙ থেকে অম্বুজবাবু সব শুনে কিছু বলে যাচ্ছেন আর প্রণবেশ আমার প্যাডে খসখস করে তা লিখে নিচ্ছে।

প্রায় দশ মিনিট পর প্রণবেশ টেলিফোন রেখে আমার দিকে তাকাল। বলল, নষ্ট করার মতো আর একটা মিনিটও সময় নেই। শীগগির একজন ছুতোর ডাকো।

ছুতোর!

হ্যাঁ। অম্বুজবাবু বলছেন ভয়ংকর বিপদ। জীবন্ত কংকালটা এখানে এসে পড়বেই। আর তা আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে। বাঁচার একমাত্র পথ–এর মধ্যে বাড়ির সমস্ত জানলা-দরজায় কাচ বসাতে হবে। অর্থাৎ কাচের দরজা-জানলা। আর জানলা-দরজার ফ্রেমও বদলাতে বলছে। নতুন করে যে কাঠ দিতে বলছে তা শুধু তিব্বতেই পাওয়া যায়। সে কাঠ এখানে পাওয়া সম্ভব নয়। তার বদলে নিমকাঠের ফ্রেম করা চলবে। কিন্তু সব জানলা-দরজার ফ্রেম এত তাড়াতাড়ি বদলানো যাবে না। তাই উনি বলছেন প্রত্যেক দরজা-জানলায় এক টুকরো নিমকাঠ লাগিয়ে দিতে। আর দরজা-জানলা রাত্তিরে কোনো কারণেই খোলা রাখা যাবে না।

আমি হাঁ করে ওর কথা শুনছিলাম। ও আমার হাত ধরে টান দিয়ে বলল, আর বসে থাকলে চলবে না। চলো ছুতোরের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি।

বেলা দশটার মধ্যেই একসঙ্গে পাঁচজন ছুতোর এসে কাজে লেগে পড়ল। সারা দিন-রাত কাজ করবে। ডবলেরও বেশি মজুরি দিতে হবে। আমি তাতেই রাজী হয়েছি। সারা দুপুর কাঠ কাটা, হাতুড়ি ঠোকার খটাখট শব্দ। এদিকে পাড়ার লোকেও সন্ত্রস্ত। তারাও কাগজে জীবন্ত কংকালের খবর পড়েছে। তিনি সল্টলেকের দিকে আসছেন এটা জেনেই ভয়ে কাটা। তারপর যখন শুনল কংকালটার টার্গেট আমাদের এই বাড়িটা তখন তাদের মুখের কথাও বন্ধ। হয়ে গেল। কংকালটা তাহলে একেবারে তাদের বাড়ির পাশে এসে পড়বে! ভুল করে যদি অন্য কারও বাড়ি ঢুকে পড়ে? তারপর যখন তারা দেখল আমার বাড়ির দরজা-জানলা কাচের করা হচ্ছে তখন তাদের ভয় আরও বেড়ে গেল। আত্মরক্ষার জন্যে যদি একজন পুলিশ অফিসারের বাড়ির দরজা জানলা হঠাৎ কাচ দিয়ে মুড়তে হয় তাহলে কী ভয়াবহ ঘটনা আজ-কালের মধ্যে ঘটতে চলেছে!

বিকেল চারটে।

আজ ছুটি নিয়ে জানলা-দরজায় কাচ লাগানোর তদারকি করছি–পাড়ার প্রৌঢ় উমেশ সান্যাল এসে দাঁড়ালেন। ভাবলাম আর-সবাইয়ের মতো উনিও বুঝি কাচ লাগানো দেখতে এসেছেন। কিন্তু না–তিনি ভারী গলায় বললেন, বিপদের ওপর বিপদ ডেকে আনতে চান?

আমি অবাক হয়ে তাকালাম। জিজ্ঞেস করলাম, কেন?

শখ করে না হয় ছাদের আলসেতে ফুলগাছের টব বসিয়েছেন। কিন্তু একটা টব যে আলসে থেকে ঝুলছে সে খেয়াল রেখেছেন? কারো মাথায় পড়লে কি হবে?

টবের কথায় চমকে উঠলাম। টবের সারি থেকে একটা টব যে খানিকটা বেরিয়ে এসেছিল কদিন আগে তা দেখেছিলাম। তারপর আর খেয়াল করিনি। উমেশবাবুর কথায় তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে যা দেখলাম তাতে চক্ষুস্থির! সেই টবটা লাইন ছেড়ে বেরিয়ে এসে একেবারে কার্নিসের ধারে পৌঁছেছে। আমি এতই ঘাবড়ে গেলাম যে উমেশবাবুর সামনেই চিৎকার করে উঠলাম কেমন করে এটা সম্ভব?

.

০৭.

ঘোরের মধ্যে সারাদিন

পরের দিন সকাল সাতটা।

একটা জিপ এসে দাঁড়াল। বুঝলাম প্রণবেশ এসেছে। ও এত সকালে এলে আমার কেমন ভয় করে। না জানি কী দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে।

খুব ব্যস্তভাবে ঢুকল প্রণবেশ। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম।

ও কোনো ভূমিকা না করে বল, শীগগির আমার জিপে ওঠো।

ভয়-উদ্বেগ মেশানো গলায় বললাম, কেন?

কথা বাড়িও না। উঠে পড়ো।

তাড়াতাড়ি পোশাক বদলে জিপে উঠে পড়লাম। পনেরো মিনিটের মধ্যে জিপ এসে থামল ইস্টার্ন বাইপাসের মুখে। নেমে পড়লাম জিপ থেকে। রাস্তার মাঝখানে বেশ ভিড় জমে আছে। সশস্ত্র পুলিশও রয়েছে। খবরের কাগজের লোকেরাও এরই মধ্যে ছুটে এসেছে।

ভিড় ঠেলে প্রণবেশ আমাকে নিয়ে গেল জায়গাটায়। ভেবেছিলাম না জানি কী বড়োরকম দুর্ঘটনা ঘটেছে।

কিন্তু সেরকম কিছু নয়। একটা কুকুর পড়ে আছে। মাথাটা তার থ্যাতলানো।

এ আর আশ্চর্য কী! রাত্তির বেলায় রাস্তার একটা কুকুর গাড়ি চাপা পড়েছে।

কিন্তু একটু পরেই ভুল ভাঙল যখন প্রণবেশ একটা লাঠি দিয়ে মরা কুকুরটাকে চিৎ করে দিল। দেখলাম তার পেটটা কেউ যেন ধারালো অস্ত্র দিয়ে চিরে ফেলেছে। নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে এসেছে।

বুঝতে পারলে কিছু? প্রণবেশ আমার দিকে তাকাল।

বললাম, এ তো গাড়ি চাপা পড়ে মরা নয়। কুকুরটার পেট চিরে কেউ মেরেছে। তারপর আক্রোশে মাথাটা ঘেঁৎলে দিয়েছে।

বুঝতে আর অসুবিধে হলো না। শুধু বললাম, তাহলে সুব্বা সল্টলেকের মুখে ঢুকে পড়েছে।

হ্যাঁ। কুকুরটা বোধহয় অদ্ভুত কিছু দেখে তাকে বিরক্ত করছিল–তারই প্রতিফল।

কেমন একটা আচ্ছন্নের মতো বাড়ি এসে ঢুকলাম। তাহলে সত্যিই আর রেহাই নেই। এখন তাহলে দিন-রাত দরজা-জানলা বন্ধ করে বাড়িতে বসে থাকা। কিন্তু তাই বা সম্ভব কি করে? ডিউটি আছে। ভূতের ভয়ে ছুটি নিয়ে বাড়ি বসে থাকা তো যাবে না।

আশ্চর্য! সারা দিনটা যেন কেমন ঘোরের মধ্যে রইলাম। নোটন ইস্কুলে গেছে। আমার স্ত্রী গম্ভীর বিষণ্ণ মুখে রান্নাবান্না করে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুলেন। সারা দুপুর একটা কাক বাড়ির ছাদে বসে কা-কা করে ডেকেই চলল। সামনের বাড়ির দেওয়াল থেকে একটা চাঙর আচমকা ভেঙে পড়ল। ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে এসবই আমি দেখে যাচ্ছি। কিন্তু যেন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখা।

হঠাৎ আমার মনে হলো আমি যেন নেপালের কাঠমাণ্ডু থেকে জিপে করে চলেছি সেই পাহাড়তলিতে যেখানে সেই নিষ্ঠুর তান্ত্রিককে দেখেছিলাম। সেই পাইনগাছে ঘেরা উঁচু উঁচু পাহাড়। জিপ কখনো উঠছে কখনো নামছে…তারপরই দেখলাম সেই ছেলেটাকে কয়েকজন পাহাড়ী বিষ্ণুমতী নদীতে স্নান করিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলি দেবার জন্যে। পাহাড়ের গুহা থেকে খাঁড়া হাতে বেরিয়ে এল সেই নিষ্ঠুর তান্ত্রিক–পেছনে গুহার গায়ে বাঁশের খুঁটোয় ঝুলছে চোদ্দ পনেরো বছরের ছেলের সেই কংকালটা….তান্ত্রিক বলি দেবার জন্য খাঁড়া তুলল…আমি বলে উঠলাম, প্রণবেশ–ফায়ার

চমকে উঠলাম। কোথায় চলে গিয়েছিলাম আমি? এ তো শুধু ভাবা বা মনে করা নয়, সত্যিই যেন কেউ আমাকে কিছুক্ষণের জন্যে নিয়ে গিয়েছিল কাঠমাণ্ডুতে। না, ভুল। এই তো আমি আমার ঘরেই বসে রয়েছি ইজিচেয়ারে। তাহলে এমন হলো কেন?

হঠাৎ বাইরে তাকিয়ে দেখি এই বেলা চারটেতেই চারিদিকে যেন ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে। আশেপাশের বাড়িগুলো যেন আর নেই। অদৃশ্য। তার জায়গায় শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। একটা কোনো মানুষ-জন নেই–ছেলেদের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে না….কি হলো? কোথায় গেল সব? আমি কেমন ভয় পেয়ে ডেকে উঠলাম, নোটন!

নোটনের মা ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

ওরকম করে চেঁচিয়ে উঠলে কেন?

আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, না। ওকে দেখছি না যে?

ও তো এই মাত্র খেলতে গেল।

বললাম, চারিদিকে ধোঁয়া। এর মধ্যে ও বেরোল কেন?

নোটনের মা বললেন, ধোঁয়া! ধোঁয়া কোথায়? স্বপ্ন দেখছ নাকি?

স্বপ্ন! যাক নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু এরকম দেখলাম কেন?

আমার স্ত্রী তখনও দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ টেবিলের ওপর নজর পড়ল। চমকে উঠে বললাম, আচ্ছা, টেবিলে ওটা কি?

কোনটি?

ঐ যে!

ওটা তো সিগারেটের প্যাকেট।

সিগারেটের প্যাকেট। ও আচ্ছা।

কি হয়েছে তোমার?

গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। বললাম, না, কিছু হয়নি। আমি একটু ঘুরে আসি।

দাঁড়াও। চা করে দিই।

আমি চা খাইনি?

এই তো সাড়ে চারটে। এখনই তো চা খাও।

তবে দাও। বলে ফের ইজিচেয়ারে বসে পড়লাম।

চা খেয়ে বেরোতে যাচ্ছি স্ত্রী বললেন, তাড়াতাড়ি ফিরো কিন্তু। সন্ধে হয়ে যায়। বললাম, এখুনি ফিরব।

বেরোতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু সারা দুপুর যে ঘোরের মধ্যে ছিলাম সেই ঘোরটাকে কাটাবার জন্যেই জোর করে বেরোলাম। বুঝতে পারছিলাম না আজ আমার মনটা কেন ওরকম হচ্ছিল।

একে সল্টলেক জায়গাটাই ফাঁকা। তার ওপর আমাদের এ. জে. ব্লকটা আরও ফাঁকা। কে বলবে এটা কলকাতা শহর! এখন এই পড়ন্ত বেলায় রাস্তাগুলো যেন বড়োই নির্জন বলে মনে হচ্ছে। অথচ অন্যদিন তেমন মনে হতো না। তবে কি জীবন্ত কংকালের ভয়ে সবাই এরই মধ্যে বাড়ি ঢুকে গেছে? আশ্চর্য! এমন সাজানো-গোছানো সল্টলেক সিটি–এত সুন্দর সুন্দর বাড়ি কল্পনা করা যায় গভীর রাতে এই পথেই হবে ভয়ংকর জীবন্ত কংকালের আবির্ভাব?

অবশ্য–অবশ্য সল্টলেক না হয় আজই সুন্দরী সিটি হয়েছে কিন্তু আজ থেকে মাত্র ছত্রিশ বছর আগে এই জায়গাটা ছিল বিস্তীর্ণ জলাজমি। মাছ চাষের ভেড়ি। তখনকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর চেষ্টায় ১৯৬২ সালে শুরু হলো গঙ্গার পলিমাটি দিয়ে সল্টলেক ভরাট করার কাজ। ১৯৬৪ সালে বালি দিয়ে ভরাট করে গড়ে ওঠে লবণহ্রদ। জোব চার্নকের পর এই প্রথম কলকাতা। তার পূর্ববর্তী জলাভূমির নাগপাশ ভেদ করে নতুন রূপ নিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠল। তারপর আর চার বছরের মধ্যে সেই পরিত্যক্ত জলাভূমির জায়গায়। দেখা দিল এক আদিগন্ত সমতলভূমি। চাঁদের পিঠের মতো রুক্ষ–প্রাণীশূন্য। লবণহদের পাঁচ বর্গমাইল প্রান্তরে কোথাও এতটুকু ছায়া নেই–শুধু এদিক ওদিক ছড়ানো-ছেটানো কন্ট্রাকটারদের টিনের চালা। এক ফোঁটা পানীয় জল নেই কোথাও–না আছে পাখি, না প্রজাপতি-না একটা ফড়িং। সেদিন তখনও রাস্তাঘাট তৈরি হয়নি, যানবাহনের প্রশ্নই নেই। স্থানীয় থানার এক দারোগা খুন হয়েছিল এখানে। কাঁকুড়গাছি ছাড়িয়ে কেউ এদিকে আসতে সাহস পেত না। রাত্তিরে চাঁদের আলোয় ধু ধু সাদা বালি দেখে মনে হতো এক বিচিত্র মরুভূমি।

হঠাৎ-হঠাৎই যেন গোঁ গোঁ করে কোথা থেকে ছুটে এল ধুলোর ঝড়। না, ধুলো নয়–বালি–শুধু বালি–বালির ঝড়। চমকে উঠলাম–এত বালি এল কোথা থেকে? তারপরেই দেখি ধু ধু সাদা বালির সমুদ্রে দিশেহারা পথিকের মতো আমি একা দাঁড়িয়ে। ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম–কে আছ বাঁচাও!…..

যখন জ্ঞান ফিরল দেখি একজনদের বাড়ির সিঁড়ির ওপর বসে আছি।

দুচারজন ভদ্রলোক আমায় ঘিরে রয়েছেন। একজন বললেন, কেমন। আছেন এখন?

অস্ফুট স্বরে বললাম, আমার কি হয়েছিল?

বোধহয় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। আপনি কোথায় থাকেন?

আমি ঠিকানা বললাম। ওঁরা চমকে উঠলেন। বললেন, হেঁটে হেঁটে এত দূর এসেছিলেন!

তারা যখন আমায় সাইকেল রিকশা করে বাড়ি পৌঁছে দিলেন তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকে দরজা-জানলা বন্ধ করে দিলাম।

সাবধানের মার নেই-তাই ভালো করে ঘরের কোণ, খাটের তলা দেখে নিলাম। কেউ ঘরে ঢুকে লুকিয়ে নেই তো?

সমস্ত বাড়িটা যেন থমথম করছে। নোটন পর্যন্ত যেন কেমন যোবা হয়ে গেছে। সে পরিষ্কারভাবে কিছু বুঝতে না পারলেও বোঝা যাচ্ছে ভয় পেয়েছে।

স্ত্রীর মুখে হাসি তো নেইই, কথাও নেই। রাত নটার সময়ে শুধু বললেন, আমার মনে হয় তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়া উচিত। অর্থাৎ শুয়ে পড়লেই যেন নিশ্চিন্ত।

তাই হলো। খাওয়া-দাওয়া সেরে যখন শুলাম তখন ঘড়িতে দশটা বেজেছে।

পাশের ঘরে নোটন আর নোটনের মা শোয়। পাশের ঘরে আমি একা। অন্য দিন আমরা আলো নিভিয়ে দিই। নোটনের মা আজ নাইট-ল্যাম্প জ্বেলে রাখলেন। আমি নিজেকেই নিজে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আজ এত ভয় পাচ্ছি। কেন? নোটনের মাও তো দেখছি ভয় পেয়েছে। কিন্তু কিসের ভয়? ও ও কি মনে করছে আজ রাত্তিরেই সুব্বা হানা দেবে?

ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হলো খুব গরম লাগছে। পাখা কি বন্ধ হয়ে গেছে? টর্চ জ্বালোম। না, পাখা তো দিব্যি চলছে। তখন মনে হলো জানলাগুলো সব বন্ধ। তাই

জানলা খুলতে যাচ্ছিলাম, তখনই মনে হলোজানলা খোলা তো নিষেধ। কাজেই মশারির মধ্যে নিজেকে আবার গুটিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লাম।

সবে চোখ বুজিয়েছি অমনি দুম করে একটা শব্দ–আমাদের বাড়ির মধ্যে। আমি চমকে উঠে বসলাম। পাশের ঘর থেকে আমার স্ত্রী চিৎকার করে উঠলেন, ওগো, শুনছ!

আমি তাড়াতাড়ি উঠে ও ঘরে গেলাম। তারপরে দুজনে মিলে ঘর-বারান্দা খুঁজলাম। কোথাও কিছু নেই।

একবার বাইরেটা দেখে আসব?

স্ত্রী কঠিন স্বরে বললেন, না। দরজা খুলবে না।

অগত্যা আবার বিছানায় গিয়ে ঢুকলাম। এবার রিভলভারটা নিয়ে রাখলাম বালিশের নিচে। ঘড়িতে তখন রাত আড়াইটে বেজেছে।

ভোরে উঠেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম সেই ফুলগাছের টবটা ছাদ থেকে পড়ে চুরমার হয়ে গেছে।

.

০৮.

গভীর রাতে পড়া মুখস্থ?

সকালবেলায় পাড়ার উমেশ সান্যাল এলেন। বললেন, খুব বেঁচে গেলেন। মশাই। টবটা যদি কারো মাথায় পড়ত তাহলে আর রক্ষে থাকত না। বড়োলোকদের যে কী ফ্যাশান হয়েছে ছাদের আলসেতে, বারান্দায় ফুলের টব ঝুলিয়ে রাখা। কারো মাথায় পড়তে পারে এ কাণ্ডজ্ঞান নেই!

একটু থেমে বললেন, আজকের কাগজ দেখেছেন?

বললাম, দেখেছি। তবে ভালো করে পড়া হয়নি। বললাম না যে ভয়ে এখন কাগজ পড়ি না।

সুখবর আছে। বলে ঝুলি থেকে সেদিনের কাগজটা বের করে দেখালেন।

‘জীবন্ত কংকাল অদৃশ্য’ হেডিং দিয়ে–যে খবরটা ছাপা হয়েছে তা এইরকম ইস্টার্ন বাইপাসের মুখ থেকে সল্টলেকের প্রায় প্রতিটি পথে পুলিশ সারা রাত্রি টহল দিয়েও জীবন্ত কংকালটিকে দেখতে পায়নি। বোধ হয় ওটি অদৃশ্য হয়েছে।

বাঁচলাম মশাই। বাড়িতে সবাইকে রেখে কাশীতে যে মহাযোগ হতে যাচ্ছে সেখানে এবার নিশ্চিন্তে যেতে পারব। দেশ-বিদেশ থেকে কত সাধু-সন্ন্যাসী কলকাতা হয়ে যাবেন। সে এক দেখার জিনিস মশাই। একবার যদি তেমন কোনো সাধুর দর্শন পাই তাহলে তার পা দুটো আঁকড়ে ধরব। বুঝলেন না ওখানে যেসব সাধু-সন্ন্যসীরা যান তারা হেঁজিপেজি ভণ্ড সাধু নন। কি বলেন?

আমি কোনো উত্তর দিলাম না। আমার মনে তখন শুধু একটা কথাই ঘুরছিল, সত্যিই কি রাজু ফিরে গেছে?

সেদিন বিকেল পর্যন্ত প্রণবেশ দুবার ফোন করেছিল। বিশেষ কাজে আটকে গেছে বলে আসতে পারছে না। জানতে চেয়েছিল ভয় পাচ্ছি না তো?

বলেছিলাম, না। তবে টবটা পড়ে গেছে। ও যেন সে কথায় কোনো গুরুত্বই। দিল না।

ক্রমে গোটা সল্টলেকের ওপর সন্ধের অন্ধকার পায়ে পায়ে নেমে এল। আজ আর বিকেলে বেরোতে ইচ্ছে করেনি। তাড়াতাড়ি সব জানলা-দরজা বন্ধ করে দিলাম। ব্যস্! রাতের মতো ঘরে বন্দী হয়ে রইলাম।

আজও রাত নটার মধ্যে খেয়ে দশটার মধ্যে শুয়ে পড়লাম। এত সকাল সকাল শোওয়া আমাদের অভ্যেস নয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম।

ভাবতে ভাবতে কখন এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমটা ভেঙে গেল আচমকাই। ঘরের মধ্যে অসহ্য গুমোট। চারিদিকের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে। আর তখনই শুনতে পেলাম জনমানবশূন্য নিস্তব্ধ পথের ওপর একটা অস্পষ্ট শব্দ খটখট খট্‌।

কেউ যেন রক্তমাংসশূন্য হাড়ের পা ফেলে হাঁটছে। শব্দটা ক্রমে এগিয়ে এল আমাদের বাড়ির কাছে। আজই তা হলে সেই রাত। ও এসে পড়েছে। আমি বালিশের তলা থেকে রিভলভারটা বের করে উঠে বসলাম।

শব্দটা থেমে গেল।

কোনো সন্দেহ নেই কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে বাড়ির কাছে। আমি বিছানায় বসেই কাচের শার্সির মধ্যে দিয়ে দেখবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেলাম না।

তার একটু পরেই আমি আঁৎকে উঠলাম। দেখলাম আমার মাথার কাছে জানলার ওপাশে একটা ভয়ংকর মূর্তি–যেন কাঠের তৈরি খসখসে একটা মুখ-নারকেলের মতো ছোট্ট মাথা–খাড়াখাড়া চুল–দুটো চোখ-হ্যাঁ, চোখই। তবে টর্চের বাম্বের মতো নয়, চোখ দুটো ওল্টানো। শুধু চোখের সাদাটা দেখা যাচ্ছে। এইভাবেই এক-এক সময়ে সুব্বা হরিদেবপুরের বাড়িতে তাকাতো।

সেই মুহূর্তে আমি কি করব ভেবে পেলাম না। দেখলাম ক্ষীণ কংকালসার দেহটা জানলাটা খোলবার চেষ্টা করছে। কিন্তু কাচের শার্সি কিছুতেই ছুঁতে পারছে না।

আমি হঠাৎ লাফিয়ে হুংকার দিয়ে জানলার দিকে ছুটে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে মূর্তিটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

এবার আমি আলো জ্বেলে পাশের ঘরে গেলাম। দেখি মশারির মধ্যে আমার স্ত্রী নোটনকে বুকে আঁকড়ে ধরে গোঙাচ্ছেন। আমাকে দেখে সাহসে ভর করে বিছানায় উঠে বসলেন। কোনোরকমে বললেন, সুব্বা ওঁদের জানলার কাছেও এসে দাঁড়িয়ে ছিল।

.

ভোরবেলায় ফোন পেয়েই প্রণবেশ জিপ নিয়ে চলে এল। সব কথা শুনে ওর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। তখনই দার্জিলিঙে ফোন করল। কিন্তু অম্বুজ লাহিড়িকে পাওয়া গেল না। তিনি দার্জিলিঙের বাইরে কোথায় গেছেন কয়েক দিনের জন্যে।

প্রণবেশ বলল, ঘাবড়িও না। রাত্রে আমিও এখানে থাকব।

শুনে বাঁচলাম। বিপদের সময়ে সঙ্গে একজন সাহসী সঙ্গী থাকা দরকার। দরকার পরামর্শ করবার।

সন্ধের আগেই প্রণবেশ চলে এল। সঙ্গে কিছু ওষুধ-পত্তর এনেছে। বলা যায় না রাত্তিরে যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন কাজে লাগবে। কোনোরকমেই দরজা খুলে বাইরে বেরোনো তো চলবে না।

রাত দশটার মধ্যে খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়া গেল। যে প্রণবেশ এত ফুর্তিবাজ–এত গল্প করে সেইই আজ যেন বোবা হয়ে গেছে। সব সময়েই কি যেন চিন্তা করছে।

ও আর আমি এক বিছানায় শুয়েছি।

কোনো বাড়ির দেওয়ালঘড়িতে ঠং-ঠং করে দুটো বাজল। সেই শব্দটুকু থেমে যেতে-না-যেতেই নিস্তব্ধ রাস্তায় কোথায় যেন শব্দ হলো খট-খট-খট

প্রণবেশকে ঠেলা দিতেই ও গম্ভীর গলায় বলল, শুনছি।

ক্রমে শব্দটা আগের দিনের মতোই বাড়ির কাছে এসে থামল। কিন্তু আজ আরও একটা অস্পষ্ট শব্দ কানে আসছিল। মানুষের গলা। কোনো বয়স্ক লোক যেন পড়া মুখস্থ করছে। এত রাত্রে কে কোথায় কী পড়ছে ভেবে ওঠার আগেই পাশের ঘর থেকে নোটনের মা চিৎকার করে উঠলেন, সঙ্গে সঙ্গে আমরা দুজনে ছুটে গেলাম ওদের ঘরে। আমাদের দেখেই আমার স্ত্রী আঙুল তুলে জানলাটা দেখিয়ে উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ঐ-ঐ– ঐদিকে।

সেই নিষ্প্রাণ কালো মুখটাকে মুহূর্তের জন্যে দেখলাম সরে যেতে। তারপর আমার স্ত্রী যা বললেন তা এই

একটা কেমন ঘোঁৎ ঘোঁৎ আওয়াজে ঘুম ভাঙতেই দেখেন মূর্তিটা বাইরে দাঁড়িয়ে জানলাটা ধরবার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। যতই পারছে না ততই রাগে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করছে। কিন্তু এ যেন হরিদেবপুরের সে রাজু নয়। তার চেয়ে ঢের ভয়ংকর ঢের বেশি হিংস্র।

আমরা ঠিক করলাম বাকি রাতটুকু মশার কামড় সহ্য করেও এ ঘরে বসে কাটিয়ে দেব। সেইমতো দুটো চেয়ার নিয়ে এসে গায়ে চাদর জড়িয়ে আমরা বসলাম।

প্রণবেশ সবে একটা সিগারেট ধরিয়েছে হঠাৎ মনে হলো বাড়িটা যেন কাঁপছে। তারপরেই ছাদের ওপর কে যেন ভারী পায়ে চলে বেড়াচ্ছে। এইরকম চলল ঘণ্টাখানেক। অথচ আমাদের কারুর কিছু করার নেই। বেরোনো চলবে না। ভোরের দিকে শব্দটা থেমে গেল।

সকালে ছাদে উঠে দেখলাম টবগুলো কে ভেঙেচুরে সারা ছাদে ছড়িয়ে রেখে গেছে।

চা খাবার পর আমরা আলোচনায় বসলাম। যে ভুলটা আমাদের হয়েছিল সেটা বললাম। লালবাজারে একটা ফোন করে দিলেই হতো। আমাদের না হয় ঘর থেকে বেরোবার উপায় ছিল না। কিন্তু পুলিশ তো ছাদে উঠতে পারত।

এটা যে মস্ত ভুল প্রণবেশও তা স্বীকার করল। সেই সঙ্গে আরও একটা ব্যাপার–ঐ সময়ে কাছাকাছি কোথাও কে পড়া মুখস্থ করছিল? না, তারও উত্তর তখনই খুঁজে পাওয়া গেল না।

.

০৯.

ভয়ংকর রাত

পরের দিন প্রণবেশ সোজা লালবাজারে গিয়ে গত দুদিনের ঘটনা জানিয়ে সন্ধের পর থেকে সারা রাত্তিরের জন্যে বাড়িতে পুলিশ পাহারা চাইল। লালবাজারের বড়োকর্তারা কিন্তু এবার খুব গুরুত্ব দিলেন না। তাদের বক্তব্য গত কয়েক দিন সারারাত পুলিশ সল্টলেকের সমস্ত রাস্তা টহল দিয়েছে। জীবন্ত কংকালের দর্শন পায়নি। হয় সবটাই এতদিন চোখের ভুল ছিল কিংবা সেটি অদৃশ্য হয়েছে।

প্রণবেশ সে কথা মানতে চায়নি। যাই হোক শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছে ফের যদি রাত্তিরে ঐরকম হাঙ্গামা হয়, ফোন পেলেই সশস্ত্র পুলিশ-ভ্যান যাবে।

আজও সন্ধের আগেই প্রণবেশ চলে এল আমাদের বাড়ি। ও যেন বুঝেই নিয়েছে আমার ঘরে যতদিন না সুব্বা ঢুকতে পারছে ততদিন ও হাঙ্গামা চালিয়ে যাবে।

আজও রাত দশটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা শুয়ে পড়লাম। নামেই শোওয়া–কারো চোখে ঘুম নেই।

রাত দুটো।

নিস্তব্ধ এ. জে. ব্লকের রাস্তাগুলো, দিনের বেলার ব্যস্ত কোলাহলমুখর বাস টার্মিনাসটা এখন শ্মশানের মতো পরিত্যক্ত। জনশূন্য রাস্তার বুকে লাইটপোস্টের আলোগুলো যেন পাহারা দিচ্ছে।

হঠাৎ কানে এল কাছেই কোনো বাড়িতে কোনো বয়স্ক মানুষ যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কিছু পড়ছে। আজ যেন গলার স্বরটা গতকালের চেয়ে স্পষ্ট। কিন্তু কি পড়ছে ভালো করে বোঝা গেল না। তার পরেই দেখলাম রাস্তার আললাগুলো কাঁপছে। তারপরেই ধীরে ধীরে ভোল্টেজ ডাউন হয়ে এল। সেই সঙ্গে সেই গম্ভীর গলার পড়াটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।

না, বই পড়া নয়। রীতিমতো মন্ত্র উচ্চারণ।–গচ্ছ–গচ্ছ–সংহারো– গচ্ছ–গচ্ছ–সংহারো–

মানেটা পরিষ্কার। কেউ যেন কাউকে আদেশ করছে–যাও–যাও বিনাশ করো–মেরে ফেলল।

তারপরেই শুনতে পেলাম সেই শব্দ খট-খট-খট—

জল্লাদ এগিয়ে আসছে আমাকে মারার জন্যে।

শব্দটা আগের মতোই আমাদের বাড়ির কাছে এসে থেমে গেল। আর তখনই কোথাও কিছু নেই আকাশটা ঘন মেঘে ছেয়ে গেল। কয়েকবার চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ চমকানি। তারপরেই উঠল প্রচণ্ড ঝড়। সঙ্গে সঙ্গে আমার স্ত্রী চেঁচিয়ে উঠলেন, আবার এসেছে

ছুটে গেলাম পাশের ঘরে। সেই একই দৃশ্য, তবে আরও ভয়ংকর। চোখ দুটো ধক ধক করে জ্বলছে–মুখে ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ। আজ যেন সে ঘরে ঢুকবেই।

আশ্চর্য এই ঝড়েও সে কাবু নয়।

এদিকে ঝড়ের দাপট ক্রমশই বাড়ছে। জানলা-দরজার শার্সিগুলো ঝনঝন করে উঠছে। প্রণবেশ চেঁচিয়ে উঠল, শীগগির টেবিল-চেয়ারগুলো দরজার কাছে নিয়ে এসো।

দরজাটা ঝড়ের ধাক্কায় তখন কঁপছে। আমরা টেবিল-চেয়ার-আলনা যা পেলাম সব নিয়ে এসে দরজার গায়ে ঠেসে দিলাম। ওদিকে জানলাগুলোরও একই অবস্থা। সেখানেও ডেস্ক, ট্রাঙ্ক যেখানে যা ছিল এনে চেপে ধরলাম। তার পরেই শুরু হলো ছাদের ওপর দাপাদাপি।

প্রণবেশ ছুটে গেল ফোন করতে। কিন্তু হায় কপাল! লাইন ডেড।

ক্রমে রাত পুইয়ে গেল। ঝড় থেমে গেল। যাক আজও বেঁচে গেলাম। প্রণবেশ আবার ফোন করার চেষ্টা করল। লাইন বেঁচে উঠেছে। লালবাজার জানাল এখুনি ফোর্স যাচ্ছে।

প্রণবেশকে বললাম, এখন আর এসে কী হবে?

.

ভোর পাঁচটা।

লালবাজারের দুজন বড়োকর্তাকে নিয়ে আমরা আলোচনায় বসেছি। এভাবে তো দিনের পর দিন পারা যায় না। কিন্তু উপায় কি?

হঠাৎ আমার একটা কথা মনে হলো। বললাম, আমরা গ্রামেও দেখেছি কংকালটাকে চালনা করে নেপালের সেই তান্ত্রিক। তার কাজ অনেকটা remote control-এর মতো। সুদূর হরিদেবপুরে নেপাল থেকে সে চলে এসেছিল। একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে সে কংকালটাকে জীবন্ত করে ছেড়ে দেয়। কাজেই সেই তান্ত্রিক কলকাতাতেও যে এসেছে তাতে সন্দেহ নেই। আর সে আছে। আমাদের খুব কাছেই।

প্রণবেশ চমকে উঠে বলল, তুমি তো দারুণ পয়েন্ট বলেছ।

মনে করে দ্যাখো প্রণবেশ, গত রাত্রে মোটা গলায় সেই সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ–গচ্ছ–গচ্ছ–সংহার।

এ সেই তান্ত্রিকেরই কাজ এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।

প্রণবেশ বলল, কিন্তু তাকে খুঁজে পাব কোথায়?

বললাম, মাঠে পথে সে বসে থাকবে না। নিশ্চয় কারো বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে। এই সেক্টরের প্রত্যেক বাড়ি খোঁজ করলে এখনও তাকে পাওয়া যাবে।

প্রণবেশ তখনই পুলিশ কর্তাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বেশি খুঁজতে হলো না। উমেশ সান্যালের বাড়ির কাছে আসতেই ঘিয়ের গন্ধ পাওয়া গেল। যেন কেউ হোম করেছে। পুলিশ ঢুকে পড়ল। উমেশবাবু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, হ্যাঁ, একজন বড়ো সাধুকে তিনদিন হলো তাঁর বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। ঠিক ছিল আজ তার সঙ্গে বেনারসে মহাযোগে যাবেন। কিন্তু

কিন্তু কি? কোথায় সেই সাধু?

ভোরবেলা উঠে তাকে আর দেখতে পাচ্ছি না।

প্রণবেশ বললে, তা হলে সে নিশ্চয় পালিয়েছে।

তখনই সব থানায় ফোন করে দেওয়া হলো–পথে, স্টেশনে, গঙ্গার ঘাটে কোনো সাধুকে একলা দেখলেই তাকে যেন ধরা হয়।

.

বেলা দশটা।

তান্ত্রিক ধরা পড়েনি। হয়তো সে ট্রেনে চড়ে নেপালের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছে। অথবা অন্য সাধুদের দলে মিশে কাশী চলে গিয়েছে।

গত রাতের ঝড়ে একটা লাইট-পোস্টের তার ছিঁড়ে গিয়েছিল। ইলেকট্রিক মিস্ত্রিদের একজন পোস্টে উঠে সারাচ্ছিল। হঠাৎ আমাদের বাড়ির ছাদের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল। আরে! ওটা কি?

ছাদে উঠে দেখা গেল–একটা ছোটোখাটো কংকাল পড়ে আছে। এটা যে নেপালে সেই তান্ত্রিকের গুহায় আমরা দেখেছিলাম সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

তান্ত্রিক অনেক দূরে চলে গেছে। রিমোট কন্ট্রোল আর চলবে না। এখন এটা শুধুই কংকাল। এটাকে নিয়ে কি হবে?

পুলিশ বলল, দায়িত্ব আমাদের। ওটাকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেওয়াই ভালো।

তাই হলো। আমাদের উপস্থিতিতে কংকালটাকে পুড়িয়ে তার ভস্ম গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হলো। আশা করা যায় এতকাল পর তার গতি হবে। তান্ত্রিকও আর রিমোট কন্ট্রোল থেকে কংকালকে চালনা করে কারো ক্ষতি করতে পারবে না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments