Tuesday, April 16, 2024
Homeকিশোর গল্পডুমনিগড়ের মানুষখেকো - সত্যজিৎ রায়

ডুমনিগড়ের মানুষখেকো – সত্যজিৎ রায়

ডুমনিগড়ের মানুষখেকো - সত্যজিৎ রায়

আমি তখন ছিলাম ডুমনিগড় নেটিভ স্টেটের ম্যানেজার, বললেন তারিণীখুড়ো।

ডুমনিগড় ম্যাপে আছে? জিজ্ঞেস করল ন্যাপলা। ন্যাপলার মুখে কিছু আটকায় না।

তোর কি ধারণা ম্যাপে যা আছে তার বাইরে আর কিছু নেই? চোখ-কান কুঁচকে বিস্ময় আর। বিরক্তি দুটোই একসঙ্গে প্রকাশ করে বললেন তারিণীখুড়ো। ম্যাপ তৈরি করে কারা? মানুষে তো! ভগবানের সৃষ্টিতে ডিফেক্ট থাকে জানিস? জোড়া মানুষ সায়ামীজ টুইসের কথা শুনিসনি? হাতে ছটা করে আঙুল, বাছুরের দুটো মাথা–এসব শুনিসনি?–ম্যাপে নেই ডুমনিগড়। এই নিয়ে ফিলিপসের অ্যাটলাস কোম্পানিকে কড়া চিঠি দিয়েছিলাম সেই সময়। তারা লিখলে, ভেরি সরি, আগামী সংস্করণে শুধরে দেবে। দেয়নি যে, সেটা স্রেফ গাফিলতি। ডুমনিগড় হচ্ছে মধ্যপ্রদেশের বাঘেলখণ্ডে। মাইহার অবধি ট্রেন, তারপর একশো বত্রিশ কিলোমিটার পূবে গাড়িতে। হল?

ন্যাপলা চুপ মেরে গেল। আমরাও বাঁচলাম, কারণ তারিণীখুড়োর গল্প শোনার আগ্রহ আমাদের সকলের সমান, ন্যাপলারও। খুড়ো আসলে আমাদের কেউ হন না, তবে খুব ছেলেবেলা থেকেই। দেখে আসছি ইনি মাঝে-মধ্যে আসেন আমাদের বাড়িতে। আমার জন্মের আগে বাবারা যখন ঢাকায় ছিলেন, তখন তারিণীখুড়ো ছিলেন আমাদের পড়শি। তাই খুড়ো। বাবারও খুড়ো, আমাদেরও খুড়ো। খুড়ো ছাড়া আর ওঁকে কেউ কিছু বলে বলে জানি না। বাবার কাছেই শুনেছি যে, ভদ্রলোক নাকি চাকরির ধান্দায় সারা ভারতবর্ষ ঘুরেছেন, আর অভিজ্ঞতাও হয়েছে বিচিত্ররকম। কাজেই গল্পের স্টক অঢেল। খুড়ো বলেন যে শুধু আর্টের খাতিরে যেটুকু কল্পনার আশ্রয় নিতে হয় সেটুকু ছাড়া নাকি সবই সত্যি।

গল্পের প্রথম লাইন বলে থেমে গেছেন খুড়ো, কারণ তাঁর ফরমাশ-মতো দুধ-চিনি ছাড়া চা এসে গেছে। এ-জিনিসটি একটু বেশি রসিয়ে রসিয়ে খাচ্ছেন দেখে ন্যাপলা অধৈর্য হয়ে বলল, ডুমনিগড়ে হলটা কী?

বলছি, বলছি, বললেন তারিণীখুড়ো। এই রটি খাওয়ার অভ্যাস আমার ডুমনিগড় থেকেই। রাজা ভূদেব সিং-এর হয়েছিল ডায়াবিটিস। এককালে সাত রঙের সাত রকম মিঠাই বরাদ্দ ছিল রোজ দুবেলা। তা ছাড়া নিয়মিত মদ্যপান করতেন। আমার ডাক পড়ত সন্ধ্যাবেলা যেদিনই খুলতেন শঁপাঞ-এর বোতল।

শঁপাঞ?–নামটা আমাদের সকলের কাছেই নতুন।

অশিক্ষিতরা যেটাকে বলে শ্যামপেন, বললেন খুড়ো। যাই হোক, রাজা একদিনে সব পরিত্যাগ করেন। আমার চোখের সামনে ষোলো স্টোন থেকে সাড়ে ন স্টোনে নেমে গেল ওজন। আর সেই সময়ই খুনটা হয়।

খুন?

আমাদের পাঁচজন শ্রোতার পাঁচ রকম গলায় একসঙ্গে উচ্চারিত হল প্রশ্নটা।

হ্যাঁ, খুন। রাজার তিন ছেলে–শ্রীপত, ভূপত আর অনুপ। ছোটটা রায়পুরে রাজকুমার কলেজে পড়ে, বড় দুটো পড়াশুনা শেষ করে ডুমনিগড়েই থাকে। বড় শ্রীপতই হল খুন। শ্রীপতের ইয়ার ছিল নারায়ণ শ্রীমল। ধনী ব্যবসাদার ডুমনিগড়ের রাইস-কিং পুরুষোত্তম শ্রীমলের একমাত্র ছেলে। জুয়ার আড্ডা বসত নারায়ণের বাড়িতে। এক সন্ধ্যায় তুমুল বচসা হয় শ্রীপত আর নারায়ণে। প্রায় হাতাহাতি। শ্রীপত জিতছিল প্রায় বিশ হাজার টাকা। সেই সময় নারায়ণের হাতে তার জোচ্চুরি ধরা পড়ে যায়। নারায়ণ শাসায় তাকে খতম করবে বলে।

যাই হোক, খেলা শেষ করে বাড়ি ফিরছিল শ্রীপত। তখন রাত এগারোটা। হেঁটেই ফিরত। রাজবাড়ি থেকে শ্রীমলদের বাড়ি হাফ-এ-মাইল। পথে পড়ে রাম সরোবর। ভারী সুদৃশ্য লেক, ঠিক মধ্যিখানে একটি শ্বেতপাথরের মিনি-প্রাসাদ, নৌকো করে যাওয়া যায় সেখানে। সেই লেকের ধারে কে জানি রিভলভার দিয়ে গুলি করে শ্রীপতকে। পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে মেরেছে, এক গুলিতেই সাবাড়। পুলিশ নারায়ণকে সন্দেহ করে। সে যে শ্রীপতকে মারবে বলে শাসিয়েছে, সে কথা জেরাতে আড্ডার সকলেই স্বীকার করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে নারায়ণ বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। আমি অবশ্য খুনের সময় কাছেই ছিলাম।

বলেন কী! আবার পাঁচটা গলা একসঙ্গে।

জোনাকি স্টাডি করছিলাম, বললেন তারিণীখুড়ো। সামনে দেওয়ালিরাজাকে কথা দিয়েছিলাম পিদ্দিমের বদলে একটা নতুন ধরনের বাতির বন্দোবস্ত করব। ইলেকট্রিক নয়। কাঁচের টিউবের অডার দিয়ে দিয়েছিলাম। রাজবাড়ির যত ব্যালকনি আর যত বারান্দা সব কটার আলসে আর রেলিঙের উপর টিউব বসানো থাকবে, আর তার মধ্যে ছাড়া থাকবে জোনাকি। অবিশ্যি নিশ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ফুটো থাকবে টিউবে। নির্ঘাত চমকপ্রদ ব্যাপার হত, তবে বড়কুমারের মৃত্যুর জন্য সেবার আর কোনও ঘটা হয়নি দেওয়ালিতে।

আপনি খুনিকে দেখেছিলেন? জিজ্ঞেস করল ন্যাপলা।

না, দেখিনি। গুলি করেই সে পালায়। তবে খুনের খবরটা আমিই দিই। আমি যদি অন্যমনস্ক থাকতাম তা হলে হয়তো খুনিকে হাতে-নাতে ধরে ফেলতে পারতাম, কিন্তু সেটা হবার ছিল না। ফলে একটা জলজ্যান্ত অপরাধী চিরকালের মতো রেহাই পেয়ে গেল।

তারিণীখুড়ো বিড়ি ধরাতে থেমেছেন, আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি, গল্প শেষ কি না তাও বুঝতে পারছি না, এমন সময় খুড়ো আবার শুরু করলেন।

এদিকে বড় ছেলের মৃত্যুতে রাজা আঘাত পেয়েছেন খুবই, আর তাতে অসুখও বেড়ে গেছে। এমন সময় একটা অন্য গণ্ডগোল দেখা দিল।

খুনের মাসখানেক আগে দুই আমেরিকান এসেছিল রাজার অতিথি হয়ে। আসল উদ্দেশ্য শিকার। ডুমনিগড়ের পুবদিকে পাহাড়ের শ্রেণী, আর তার পাদদেশে গভীর জঙ্গল। যাকে বলে হান্টারস প্যারাডাইজ। বহু বিদেশি শিকারি ডুমনিগড়ে এসে শিকার করে গেছে, রাজা তাদের জন্য ঢালাও বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। বীটাররা বন পিটিয়ে কাঁসি ক্যানেস্তারা পিটিয়ে বাঘ এনে ফেলে দিয়েছে শিকারিদের সামনে, আর তারা হাতির পিঠ থেকে শার্দুলসংহার করে খুশি মনে দেশে ফিরে গেছে।

এইবার ওই দুই আমেরিকানের একটি, নাম স্যাঙ্গার, চল্লিশ হাত দূর থেকে পর-পর দুটি গুলি মেরেও বাঘকে জখমের বেশি কিছু করতে পারল না। একটা গুলি লাগল ল্যাজে, একটা পিছনের পায়ের গোঁড়ালিতে। সেই বাঘ এখন হয়ে গেছে নরখাদক। এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, তোরা জানিস বোধহয়। পুলাম্বি, হাড় আর থুয়ারা পাহাড়ের নীচে এই তিনটি গ্রাম থেকে সতেরোজন মেয়ে-পুরুষকে ধরে নিয়ে গেছে সেই বাঘ। গাঁয়ের লোকে রাজার কাছে এসে হত্যা দিয়েছে, ওই বাঘের শেষ না দেখা পর্যন্ত তাদের সোয়াস্তি নেই। বাঘের ভয়ে তারা বাড়ি থেকে বেরোতে পারে না, সেই সুযোগে তাদের খেতের ফসল খেয়ে নিচ্ছে হরিণ আর শুয়োরের দল।

রাজা ডেকে পাঠালেন আমাকে। বললেন ট্যারিরাজা আমাকে ট্যারি বলেই ডাকতেন-ট্যারি, এখন তুমিই ভরসা। এই ম্যানইটারের একটা বিহিত না করলেই নয়। তোমার কী লোকজন লাগবে বলো, আমি দিয়ে দিচ্ছি। তুমি দু-একদিনের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ো।

এখানে বলা দরকার যে, মেজোকুমার ভূপত সিং-ও শিকারে সিদ্ধহস্ত। তেইশ বছর বয়স, কিন্তু এর মধ্যেই বড় বাঘ ছোট বাঘ মিলে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিয়াত্তর। তবে এটা জানি যে, রাজা মেজোকুমারের খুব একটা ভক্ত নন, কারণ সে অতি উজ্জ্বল প্রকৃতির ছেলে। তা ছাড়া মদ জিনিসটাকে একটু বেশিরকম পছন্দ করে। আমি মেজোকুমারের হয়ে একবার সুপারিশ করেও কোনও ফল হল না।

কাজেই আমাকেই রাজি হতে হল। আমার তখন জোয়ান বয়স, সবে ত্রিশ পেরিয়েছে। চোখে মাইনাস পাওয়ারের পুরু চশমা সত্ত্বেও অব্যর্থ টিপ। কর্নেল হোয়াইটহেড নিজে হাতে ধরে বন্দুক চালানো শিখিয়েছেন আজমীরে থাকতে।

যেখানে উৎপাতটা হচ্ছে, সেখানে পৌঁছতে হলে একটা ছোট নদী পেরোতে হয়। সে নদীর নাম লুঙ্গি কেন জিজ্ঞেস করিসনি ন্যাপলা, কারণ উত্তর আমি জানি না। এই লুঙ্গিরই পাশে এক অশ্বত্থ গাছের তলায় মাস চারেক হল এক বাবাজি এসে আস্তানা গেড়েছেন, এ-খবর আমরা পেয়েছি। রাজার আবার হোলি ম্যানে খুব বিশ্বাস; বলে দিলেন যাবার সময় আমি যেন একবার দেখা করে যাই। রাজা শুনেছেন বাবাজির কাছে নাকি অনেকরকম ওষুধ আছে; যদি ডায়াবিটিসের কোনও ওষুধ বলতে পারেন আমি যেন সেটা জেনে নিই।

জানুয়ারি মাস, প্রচণ্ড শীত পড়েছে সেবার, তারই মধ্যে দুটি বেয়ারা সমেত বেরোবার সব তোড়জোড় করে ফেললাম। রাজার কাছে বিদায় নিতে গিয়ে দেখি মেজোকুমার বসে রয়েছেন তাঁর ঘরে। বুঝলাম একটা কথা কাটাকাটির মাঝখানে গিয়ে পড়েছি। রাজা তখনও হাঁপাচ্ছেন, এবং আমার সামনেই মেজোকুমারকে কড়া কথা শুনিয়ে তাঁকে ঘর থেকে বিদায় করে দিলেন। বেরোবার মুখে কুমার আমার প্রতি যে দৃষ্টি হানলেন, সেটা মোটেই প্রসন্ন নয়। বুঝলাম তাঁকে বাদ দিয়ে আমাকে বাঘ মারতে পাঠানো হচ্ছে সেটা আদৌ ওঁর মনঃপূত নয়। তবে সিদ্ধান্তটা তো আমার নয়, সেটার জন্য দায়ী স্বয়ং রাজা ভূদেব সিং। কাজেই আমার উপর চোখ রাঙানোর কারণটা বোধগম্য। হল না।

লুঙ্গি নদী ডুমনিগড় থেকে ৩২ মাইল, অর্থাৎ আজকের হিসেবে পঞ্চাশ কিলোমিটার। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলেছে, তবে ডুমনিগড়ে জিপ আসেনি। রাজার একটা পুরনো ফোর্ড ছিল, সেটা খুব। মজবুত। তাতে করেই পৌঁছে গেলাম এক ঘণ্টার ভেতর। শিকারের জন্য যাবতীয় যা কিছু দরকার, সবই সঙ্গে এসেছে। নদী পেরিয়ে আরও যেতে হবে সতেরো মাইল, তার জন্য ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের গাড়ি থাকবে ওপারে। রেঞ্জার নিজেও থাকবেন, আমরা গিয়ে উঠব ফরেস্ট রেস্ট হাউসে।

অবিশ্যি ওপারে যাবার আগে একটা কর্তব্য সারতে হল। উদাস বাবার আশ্রমে একবার টু দিতে হল। গেরুয়াধারী বাবাজি শিষ্য-শিষ্যা-পরিবেষ্টিত হয়ে পর্ণকুটিরের সামনে বাঘছালের উপর বসেছেন, সামনে ধুনি জ্বলছে। চেহারাটি বেশ ভক্তি-উদ্রেককারী, দাড়ি-গোঁফ-জটা সত্ত্বেও অনেক সাধুর চেয়ে বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, জংলিভাব একেবারেই নেই।

সাধু আমাকে দেখেই স্মিতহাস্য করে আইয়ে বলে তাঁর সামনে একটা জায়গা দেখিয়ে দিলেন। আমি গিয়ে বসলাম। সাধু চেয়ে রইলেন আমার দিকে। ঠোঁটের কোণে সেই স্মিত হাসির রেশ। মনে মনে ভাবছি এত দেখার কী আছে, এমন সময় বাবাজি হঠাৎ বলে উঠলেন, বাঙালি? এবং যেভাবে যে-উচ্চারণে বললেন তাতে বুঝলাম ইনি নিজেও বাঙালি। এতে অবাক হলাম বই কী, কারণ যেদিন থেকে বাবাজি আস্তানা গেড়েছেন সেদিন থেকে শুনছি এনার কথা, কিন্তু কেউ বলেনি ইনি বঙ্গসন্তান।

কী চাস তুই?

এখানে বলি রাখি, বাবাজিদের এই হোলসেল তুইতোকারির ব্যাপারটা আমি মোটে বরদাস্ত করতে পারি না। তাই এনার প্রশ্ন শুনে ধাঁ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল। বললাম, রাজার অনুরোধে তোর সঙ্গে দেখা করতে এলাম।

বাবা কিন্তু আমার মুখে তুই শুনে মোটেই বিরক্ত বা বিচলিত হলেন না। বরং এবার যে কথাটা বললেন, তাতে আমি হকচকিয়ে গেলাম তো বটেই, সেই সঙ্গে বেশ খানিকটা নও হয়ে গেলাম।

রাজার জন্য ওষুধ আমি দিয়ে দিচ্ছি। বলিস চিন্তা করার কিছু নেই। অসুখ সেরে যাবে, তবে পুত্রশোক থেকে রেহাই নেই। বড়টা গেছে, পরেরটাও যাবে। ছোটটি ভাল ছেলে, সেই বাপের মুখ রাখবে। তবে রাজত্ব নেই কপালে, কারণ রাজা আর থাকবে না দেশে। দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে।

আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছি না, এমন সময় বাবাজি বললেন, তোর জন্যেও ওষুধ আছে।

আমার ওষুধ? সে আবার কী? জিজ্ঞেস করলাম, কীসের ওষুধ?

তুই বাঘের পেটে যেতে চাস?

সেটা আর কে চায় বলুন।

তা হলে আরও কাছে আয়।

আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম সাধুবাবার দিকে। বাবাজি তাঁর ঝোলা থেকে একটা কৌটো বার করে তার থেকে খানিকটা সবুজ মলম নিয়ে আমার কপালে ঘষে দিলেন। হিঙ আর কস্তুরী মেশানো একটা গন্ধ এল নাকে।–ব্যস, আর ভয় নেই তোর।

রাজার জন্য ওষুধ নিয়ে বিদায় নিলাম। মনে-মনে বললাম, বাবাজির ক্ষমতা অসীম, কারণ আমার কাছ থেকে তুই থেকে আপনি সম্বোধন আদায় করে নিতে লেগেছে ঠিক দু মিনিট।

রেস্ট হাউসে পৌঁছে গেলাম আধ ঘণ্টার মধ্যেই। গিয়ে দেখি সব ব্যবস্থা হয়ে আছে। আমি আসছি সে-খবর আগেই পৌঁছে গেছে, তিন গাঁয়ের তিন মোড়ল এসেছে আমার সঙ্গে দেখা করতে। বললাম আমার যতদুর সাধ্যি আমি করব।

শীতকালের দিন ছোট, তাই সাড়ে চারটের মধ্যে বনমোরগের রোস্ট খেয়ে বেরোবার জন্য তৈরি হয়ে গেলাম। স্থানীয় শিকারি শুকদেও তেওয়ারি আমাকে সাহায্য করছে; সে মাচা বাঁধার জন্য গাছ। বেছে রেখেছে সমতল জমি যেখানে শেষ হয়ে পাহাড় শুরু হয়েছে সেইরকম একটা জায়গায়। কাছাকাছির মধ্যে বাঘের পায়ের টাটকা ছাপ পাওয়া গেছে। একটি মোষও কেনা হয়েছে টোপ হিসেবে, সব মিলিয়ে ব্যবস্থা ভালই। আমি একাই থাকব পাহারায়, সকালে শিকারি ও কুলির দল। এসে আমায় মিট করবে। তার মধ্যে যদি কাজ সারা হয়ে যায় তো ভালই, নইলে কাল সন্ধে থেকে আবার বসতে হবে। এভাবে কতদিন চলবে জানা নেই।

রেস্ট হাউস ছাড়বার মুখে আরেকটা গাড়ির আওয়াজ পেলাম। এ-আওয়াজ আমার চেনা। এ হল মেজোকুমারের পন্টিয়াক টুরার। ব্যাপার কী?

মেজোকুমার গাড়ি থেকে নেমেই কারণটা জানিয়ে দিলেন। বললেন বাবাকে বলে রাজি করিয়েছেন, তিনিও আমার সঙ্গে নরখাদকের সন্ধানে যাবেন। এমন একটা গুরু দায়িত্ব শুধু একজনের উপর দেওয়ার কোনও মানে হয় না।–দাদার মৃত্যুতে বাবার বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে।

কথাটা শুনে আমার মোটেই ভাল লাগল না। রাজা সত্যিই অনুমতি দিয়েছেন কি না জানার কোনও উপায় নেই। আমার ধারণা তিনি বারণই করেছেন, কিন্তু ঈষাবশত ইনি নিজেই চলে এসেছেন।

কী আর করি। মনিবের সন্তান, তার সঙ্গে তো আর ঝগড়া চলে না। তখনই তেওয়ারিকে বলে একটা দ্বিতীয় মাচার বন্দোবস্ত করা হল। তবু ভাল যে, মেজোকুমার তাঁর নিজের জন্য শিকারের সব সরঞ্জাম সঙ্গেই এনেছিলেন।

দুজনে গিয়ে উঠলাম মাচাতে। আমারটা শিমুল গাছ, ওনারটা বাদাম। আমাদের রেখে দল ফিরে গেল। আমরা রাত্রি জাগরণের জন্য তৈরি হলাম। নীচে থেকে যাতে বাঘ বুঝতে না পারে তার জন্য দুটো মাচার নীচেই লতাপাতা দিয়ে ক্যামুফলাজ করা হয়েছে। ব্যবস্থা পাকাঁপোক্ত।

কুমার দেখি মাচায় উঠে ব্র্যান্ডির বোতল খুলেছেন। আমি ইশারায় তাঁকে বারণ করার চেষ্টা করলাম, তিনি আমার দিকে চেয়েও চাইলেন না।

অন্ধকারটা যেন একটু আগে হল মনে করে আকাশের দিকে চেয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে দেখি, কালো মেঘে দিগন্ত ছেয়ে গেছে।

ছটা নাগাত বিদ্যুৎ ও বজ্রপাতের সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। বাঘ বৃষ্টির তোয়াক্কা করে না, শিকারিরও করা উচিত নয়, কিন্তু শীতকালের বৃষ্টি বলেই বোধহয় অনুভব করলাম ওভারকোট ভেদ করে বরফের মতো ঠাণ্ডা জল আমায় কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। এমনিতে আমার অসুখ-বিসুখ হয় না বললেই চলে, কিন্তু সর্দি জিনিসটাকে আমি বড় ভয় পাই। এটা চিরকালের ব্যাপার। যখন একটা হাঁচি হল, তখন প্রমাদ গুনলাম। মাচায় বসা শিকারির পক্ষে হাঁসি কাশি যে কী সর্বনেশে ব্যাপার, তা বোধহয় তোদর বুঝিয়ে বলতে হবে না। তা ছাড়া হঠাৎ মনে পড়ে গেল ছেলেবেলায় এক জ্যোতিষী বলেছিল আমার অপঘাতে মৃত্যু হতে পারে। একে বাজ পড়ছে, তায় গাছের উপর বসা। পরিস্থিতিটা মোটেই ভাল লাগল না।

এবার কুমারকে ইশারা করে জানালাম আমি মাচা থেকে নেমে পড়ছি। আজ আর ম্যানইটারের সঙ্গে মোকাবিলা হবে না, কারণ এই হচি শুনে তিনি আর এ-তল্লাটে আসবেন না।

নীচে মোষটা জলে ছটফট করছে, আর গলায় বাঁধা ঘণ্টা অনবরত টিংটিং করছে। মাচা থেকে নামতে-নামতে মনে হল মেজোকুমারের ভাগ্য ভাল; নরখাদক সংহারের ক্রেডিটটা হয়তো তিনি একাই পাবেন। আমার এখন আশ্রয় নেওয়া ছাড়া গতি নেই; এই বৃষ্টিতে আর ভিজলে নিউমোনিয়া অবধারিত।

জঙ্গলের দুর্ভেদ্য অন্ধকারে বিদ্যুতের ঝলকানি মাঝে-মাঝে পথ দেখিয়ে দিচ্ছে। আমি টর্চের সাহায্য না নিয়েই এগিয়ে চললাম যেদিকে পাহাড় সেই দিকে। হাতে বন্দুকটা নিয়েছি, কারণ সেটার যে প্রয়োজন হবে না, এমন কোনও গ্যারান্টি নেই।

পাহাড়ের গায়েও গাছপালা ঝোঁপঝাড়ের অভাব নেই, তারই মধ্যে দিয়ে আঁচড়-প্যাঁচড় করে উঠে গিয়ে হঠাৎ সামনে একটা ঘোর অন্ধকার কী যেন এসে পড়ল। বিদ্যুতের আলোতেও যখন সে-অন্ধকার দূর হল না, তখন বুঝলাম সেটা একটা গুহার মুখ। গিয়ে ঢুকলাম ভিতরে। মাথার উপর বারিবর্ষণ দূর হল। বাঁচা গেল। শেলটার পেয়ে গেছি। পকেট থেকে টর্চ বার করে সামনে ফেলে বুঝলাম, গুহার অপর দিকের দেয়াল টর্চের আলোর নাগালের বাইরে। কমপক্ষে পাঁচশো লোক এ-গুহায় আশ্রয় নিতে পারে।

আলোতেই দেখলাম সামনেই একটা মাঝারি আকারের পাথরের চাঁই। সেটাতে পিঠ দিয়ে বসলাম গুহার মেঝেতে। বাইরে সমানে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। বিদ্যুতের আলোতে বুঝতে পারছি পাহাড়ের গা দিয়ে জলের ধারা নেমে এসে গুহার মুখের সামনে একটা ছোটখাটো জলপ্রপাতের সৃষ্টি করেছে। পকেটে সিগারেট দেশলাই ছিল। সেটা এই অবস্থায় ব্যবহারযোগ্য হবে কি না ভাবছি, এমন সময় তড়িৎ-ঝলকানিতে একটা ব্যাপার দেখে চমকে উঠলাম।

একটি লোক এসে গুহার ভিতর ঢুকল।

লোকটির সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটা থেকে বুঝতে পারলাম ইনি মেজোকুমার। তাঁর সাত বছর বয়সে পায়ের পাতার উপর দিয়ে চলে যায় বাপের রোলস রয়েস গাড়ি। সাহেব ডাক্তার মেজর স্টেবিংস-এর অস্ত্রোপচারের ফলে পা সেরে যায় ঠিকই, কিন্তু ডান পায়ের তুলনায় আধ ইঞ্চি ছোট হয়ে যায়। তার ফলেই এই খোঁড়ানো।

মেজোকুমারের অন্ধকার দেহ আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার পাশেই বসল। একটা বোটকা গন্ধ কিছুক্ষণ থেকে পাচ্ছিলাম, তার সঙ্গে এবার হেনেসি ব্র্যান্ডির গন্ধ যোগ হল। তারপর অনুভব করলাম গরম নিশ্বাস পড়ছে আমার মুখের উপর। তারপর মেজোকুমারের কণ্ঠস্বর প্রবেশ করল আমার কানে।

শত্রুর শেষ রাখতে নেই জানো?

বলে কী লোকটা? আমি ওর শত্রু হতে যাব কেন?

তোমাকে যখন আমি দেখে চিনেছি সেই রাতে, তখন তোমারও আমাকে দেখা এবং চিনে ফেলাটা আশ্চর্য নয়।

কোন্ রাতে?

সেটা কি বলে দিতে হবে? ইমলিগাছের নীচে দাঁড়িয়ে ছিলে তুমি। দাদা ফিরছিল শ্রীমলের বাড়ি থেকে।

আমার গরম লাগতে শুরু করেছে। ওভারকোটটা খুলে ফেলতে পারলে ভাল হয়। এই মেজোকুমারই তা হলে হত্যাকারী, নারায়ণ শ্রীমল নয়। দাদাকে হটিয়ে নিজে গদিতে বসার লোভ। যেমন আরও অনেক রাজপরিবারেই হয়ে থাকে। কিন্তু আমায় সে চিনল কী করে সে-রাতে?

উত্তর এল মেজোকুমারের মুখ থেকেই।

ত্রয়োদশীর চাঁদ উঠেছিল তখন। তোমার চশমার কাঁচ চকচক করছিল সেই আলোয়। এত পুরু কাঁচ ও তল্লাটে আর কারুর নেই।

আমি চুপ করে আছি। আমার চোখের পাওয়ার মাইনাস নয়। এই চশমাই আমাকে বিট্রে করল।

একটা খুট করে শব্দ পেলাম। মেজোকুমারের টোটা-ভরা রাইফেল উঁচিয়ে উঠেছে। ওর ও আমার মধ্যে ব্যবধান দুহাতের। ওই বাঘ-মারা বারো বোরের আগ্নেয়াস্ত্র এই দূরত্ব থেকে আমার উপর প্রয়োগ করলে আমার দেহ শত টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়বে গুহার চারিদিকে।

কিন্তু ওটা কী?

এক জোড়া জ্বলন্ত মার্বেল এগিয়ে আসছে আমার দিকে মেজোকুমারের পিছন থেকে। আর তার সঙ্গে সেই বোটকা গন্ধ।

সে ইয়োর প্রেয়ারস, মিস্টার ব্যানার্জি।

বিদ্যুতের আলোতে বন্দুকের ইস্পাতের নল ঝিলিক দিয়ে উঠল।

আর পরমুহূর্তেই একটা ভারী ধাতব শব্দে বুঝতে পারলাম বন্দুক গুহার মেঝেতে আছড়ে পড়েছে।

একটা গোঙানির শব্দ ক্রমে দূরে সরে গেল। আর সেই সঙ্গে জ্বলন্ত মার্বেল দুটোও।

আমি কাঠ হয়ে বসে রইলাম।

ক্রমে বজ্রবিদ্যুতের তেজ কমে এল, বৃষ্টির শব্দ থেমে এল।

বোধহয় নাভাস স্ট্রেনের দরুন, কিংবা হয়তো জ্বর ছিল শরীরে, এই ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই ঘুমিয়ে পড়ি। যখন ঘুম ভাঙল তখন ভোর হয়ে গেছে। গুহাটা যে কত বড় সেটা এখন বুঝতে পারলাম। আমি যেদিকে বসা, তার বিপরীত দিকে দেয়ালের সামনে পড়ে আছে মেজোকুমারের আধখাওয়া মৃতদেহ। কিন্তু নরখাদকের কোনও চিহ্ন নেই।

গুহার বাইরে একটা পাথর-খণ্ডের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম হাতে বন্দুক নিয়ে। একটু খুঁতখুঁত ভাব ছিল মনে, কারণ এটা জানি যে, বাঘ সুযোগ পেয়েও আমাকে খায়নি–সেটা বাবাজির মলমের জন্যেই হোক বা অন্য যে-কোনও কারণেই হোক। শুধু তাই নয়, আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে সে রক্ষা করেছে। তবে গ্রামের লোকেরা যে লাঞ্ছিত, সেকথা তো মিথ্যে নয়; তাই মন থেকে মমতা দূর করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলাম।

আটটা পর্যন্ত বসে থেকেও যখন বাঘের দেখা পেলাম না, তখন অগত্যা ফিরতি পথ ধরলাম। মাচার কী অবস্থা দেখতে হবে গিয়ে। সেখানে চায়ের ফ্লাস্ক, জলের বোতল, বালিশ কম্বল ইত্যাদি অনেক কিছুই রয়েছে।

জায়গাটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। কিন্তু যা দেখলাম তাতে চক্ষু ছানাবড়া।

মাচা সমেত শিমুল গাছ বজ্রপাতে ঝলসে গেছে, আর তার পাশেই পড়ে আছে মৃত মোষ, আর তার কাঁধে দাঁত বসানো মৃত নরখাদক। সে এক বিচিত্র ছবি। মানুষের হাতের বন্দুকের চেয়ে হাজার গুণে বেশি শক্তিশালী আগ্নেয়াস্ত্রের শিকার হয়েছে এরা, সেটা আর বলে দিতে হয় না।

ফেরার পথে বাবাজিকে ধন্যবাদ দিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু তাঁর সঙ্গে দেখা হল না। তাঁর পর্ণকুটির ভাসিয়ে নিয়ে গেছে লুঙ্গি নদী গতরাত্রের বৃষ্টিতে। তিনি নিজে নাকি একটি সেগুন গাছে চড়ে রক্ষা পেয়েছিলেন, কিন্তু আপাতত সর্দিজ্বরে কাবু হয়ে এক শিষ্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

আনন্দমেলা, পৌষ ১৩৮৮ (১৩ জানুয়ারি ১৯৮২)

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments