Tuesday, March 19, 2024
Homeবাণী-কথাহিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম (১০) – হুমায়ূন আহমেদ

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম (১০) – হুমায়ূন আহমেদ

হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম - হুমায়ূন আহমেদ

মারিয়াদের বাড়ির নাম- চিত্ৰলেখা ।
আমি দীর্ঘ পাঁচ বছর পর চিত্ৰলেখার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মানুষ তাদের বাড়ির নাম কেন রাখে? তাদের কাছে কি মনে হয় বাড়িগুলিও জীবন্ত? বাড়িদের প্রাণ আছে- তাদেরও অদৃশ্য হৃৎপিণ্ড ধকধক করে?
কলিংবেল টিপে অপেক্ষা করছি। কেউ এসে গেট খুলছে না। দারোয়ান তার খুপরিঘর থেকে আমাকে দেখতে পেয়েছে। আসছে না- কারণ উৎসাহ পাচ্ছে না। ঝকঝকে গাড়ি নিয়ে কেউ এলে এরা উৎসাহ পায়। ছুটে এসে গেট খুলে স্যালুট নিয়ে দাঁড়ায়। যারা দুপুরের রোদে ঘামতে ঘামতে আসে তাদের বেলা ভিন্ন নিয়ম। ধীরেসুস্থে এসে ধমকের গলায় বলবে- কাকে চান? দারোয়ানদের ধমক খেতে ইন্টারেস্টিং লাগে । এরা নানান ভঙ্গিতে ধমক দিতে পারে। কারও ধমকে থাকে শুধুই বিরক্তি, কারও ধমকে রাগ, কারও ধমকে আবার অবহেলা। একজনের ধমকে প্রবল ঘৃণাও পেয়েছিলাম। তার ঘৃণার কারণ স্পষ্ট হয়নি।

আমি আবারও বেল টিপে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার এমনকিছু তাড়া নেই। ঘণ্টাখানিক গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। তাড়া থাকে ভিখিরিদের । তাদের এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যেতে হয়। সময় তাদের কাছে খুবই মূল্যবান। আমার কাছে সময় মূল্যহীন। ‘চিত্ৰলেখা’-নামের চমৎকার একতলা এই বাড়িটার সামনে একঘণ্টা দাড়িয়ে থাকাও যা, দুঘণ্টা দাড়িয়ে থাকাও তা। সময় কাটানোর জন্যে কিছুএকটা করা দরকার। বাড়ির নাম নিয়ে তারা যেতে পারে। আচ্ছা, মানুষের নামে যেমন পুরুষ-রমণী ভেদাভেদ আছে—বাড়ির নামেও কি তা-ই আছে? কোনো কোনো বাড়ি হবে পুরুষবাড়ি- কোনো কোনো বাড়ি রমণীবাড়ি। চিত্ৰলেখা নিশ্চয়ই রমণীবাড়ি। সুগন্ধা, শ্রাবণী, শিউলিও মেয়েবাড়ি । পুরুষবাড়ির কোনো নাম মনে পড়ছে না। এখন থেকে রাস্তায় হাটার সময় বাড়ির নাম পড়তে পড়তে যেতে হবে, যদি কোনো পুরুষবাড়ির নাম চোখে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটা ভালো করে দেখতে হবে।

আমাকে প্রায় ঘণ্টখানিক অপেক্ষা করতে হলো- এর মধ্যে দারোয়ানশ্রেণীর একজন গেটের কাছে এসেছিল। গেট খুলতে বলায় সে বলল, যার কাছে চাবি সে ভাত খাচ্ছে। ভাত খাওয়া হলে সে খুলে দেবে। আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আপনি কি চাৰিটা এনে একটু খুলে দিতে পারেননা? এই কথায় সে বড়ই আহত হলো। মনে হলো তার সুদীর্ঘ জীবনে সে এমন অপমানসূচক কথা আর শোনেনি। কাজেই আমি বললাম, আচ্ছা থাক, আমি অপেক্ষা করি। আপনার কাছে ছাতা থাকলে আমাকে কিছুক্ষণের জন্য দিন। আমি ছাতা-মাথায় দাঁড়িয়ে থাকি, প্রচণ্ড রোদ।

সে এই রসিকতাতেও অপমানিত বোধ করল। বড় মানুষের বাড়ির কাজের মানুষদের মনে অপমানবোধ তীব্র হয়ে থাকে।
‘আপনে কার কাছে আসছেন?’
‘মারিয়ার কাছে।’
‘আপা নাই।’
‘না থাকলেও আসবে- আমি অপেক্ষা করব। গেট খুলে দিন।’
‘গেট খুলনের নিয়ম নাই।’
আগের দারোয়ানদের কেউ নেই- সব নতুন লোকজন। আগেকার কেউ হলে চিনতে পারত। এত ঝামেলা হতো না। আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, ভাইসাহেব, আপনার নাম?
‘আমার নাম আবদুস সোবহান ।’
‘সোবহান সাহেব আপনি শুনুন- আমি খুব পাগলা কিসিমের লোক। গেট না খুললে গেটের উপর দিয়ে বেয়ে চলে আসব। আপনার সাহেবের কাছে গিয়ে বলুন- হিমু এসেছে।’
‘ও আচ্ছা, আপনে হিমু? আপনের কথা বলা আছে।’
দারোয়ান ব্যস্ত হয়ে গেট খুলতে লাগল ।
আমাকে এসকর্ট করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । বিশাল ড্রয়িংরুম পার হয়ে খানিকটা খোলামেলা জায়গায় চলে এসেছি। কোনো ফার্নিচার নেই । ঘরময় কাপেট । এটা ফ্যামিলি-রুম । ফ্যামিলির সদস্যরা এই ঘরে গল্পগুজব করে, টিভি দেখে। যাদের ফ্যামিলি যত ছোট তাদের ফ্যামিলি-রুমটা তত বিশাল । মারিয়াদের ড্রয়িংরুম আগের মতোই ছিল, তবে ফ্যামিলি-রুমের সাজসজ্জা বদলেছে। প্রকাণ্ড এক পিয়ানো দেখতে পাচ্ছি। পিয়ানো আগে ছিল না । পিয়ানো কে বাজায়? মারিয়া?
ফ্যামিলি-রুমে কার্পেটের উপর হাসিখালাকে বসে থাকতে দেখলাম । তিনি তাঁর দুহাত মেলে ধরেছেন। সেই হাতের নখে নেলপালিশ লাগাচ্ছেন সিরিয়াস চেহারার এক ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের চোখে সোনালি চশমা, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। তিনি খুব একটা বাহারি পাঞ্জাবি পরে আছেন। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই বিখ্যাত ও ক্ষমতাবানদের কেউ হবেন। এবাড়িতে বিখ্যাত ও ক্ষমতাবান ছাড়া অন্য কারও প্রবেশাধিকার নেই। নেলপালিশ লাগানোর ব্যাপারে ভদ্রলোকের মনোযোগ দেখে মনে হচ্ছে কাজটা অত্যন্ত জটিল । হাসিখালাও নড়াচড়া করছেন না। স্থির হয়ে আছেন। হাসি খালা এক ঝলক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হিমু, তোর কী খবর?
‘কোনো খবর নেই।”
‘মারিয়া বলেছিল তুই আসবি ।’
যে-ভদ্রলোক নেপলিশ লাগছেন ভিন্ন রক্ত গলায় বললেন, হাসি, নড়াচড়া করবে না। নড়লে আঙুল নড়ে যায়।
আমি বললাম, খালা, হচ্ছে কী?
হাসিখালা বললেন, কী হচ্ছে তা তো দেখতেই পাচ্ছিস । নতুন কায়দায় নেলপলিশ লাগানো হচ্ছে। নখের গোড়ায় কড়া লাল রঙ । আস্তে আস্তে নখের মাথায় এসে রঙ মিলিয়ে যাবে।
‘জটিল ব্যাপার মনে হচ্ছে ।’
‘জটিল তো বটেই। জিনিসটা দাঁড়ায় কেমন সেটা হচ্ছে কথা। একধরনের এক্সপেরিমেন্ট ।’
ভদ্রলোক আরেকবার বিরক্ত গলায় বললেন- হাসি, প্লিজ।
আমি কিছুক্ষণ নেলপালিশ দেয়া দেখলাম। গাঢ় লাল, হালকা লাল, সাদা— তিন রঙের কৌটা, নেলপালিশ রিমুভার নিয়ে প্রায় হুলুস্থূল ব্যাপার হচ্ছে।
হাসিখালা বললেন, জামিল, তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি! এ হচ্ছে হিমু। ভালো নাম এভারেস্ট, কিংবা হিমালয় । মারিয়ার বাবার অনেক আবিষ্কারের এক আবিষ্কার। খুব ভালো হাত দেখতে পারে। হাত দেখে যা বলে তা-ই হয় ।
ভদ্রলোক চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন। আমি সামনে থেকে সরলে তিনি বাঁচেন এই অবস্থা। আমি বিনয়ী গলায় বলরাম, স্যার, ভালো আছেন?
ভদ্রলোক বললেন, ইয়েস, আই অ্যাম ফাইন। থ্যাঙ্ক য়্যু।
‘আপনার নেলপলিশ দেয়া খুব চমৎকার হচ্ছে স্যার।’
ভদ্রলোকের দৃষ্টি কঠিন হয়ে গেল হাসিখালী বললেন, তুই যা, মারিয়ার বাবার সঙ্গে দেখা করে আয়। আর শোন, চলে যাবার আগে আমার হাত দেখে দিবি । জামিল, তুমি কি হিমুকে দিয়ে হাত দেখাবে?
জামিল নামের ভদ্রলোক নেলপলিশের রঙ মেশানোর ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শীতল গলায় বললেন, এইসব আধিভৌতিক ব্যাপারে আমার বিশ্বাস নেই।
আমি বললাম, আধিভৌতিক বলে সবকিছু উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না স্যার । অ্যাস্ট্রলজি ছিল আধিভৌতিক ব্যাপার। সেই অ্যাস্ট্রলজি থেকে জন্ম নিয়েছে আধুনিক অ্যাস্ট্রনমি । একসময় আলকেমিও ছিল আধিভৌতিক । সেই আলকেমি থেকে আমরা পেয়েছি আধুনিক রসায়নবিদ্যা।
জামিল সাহেব বললেন, মিস্টার এভারেস্ট, এই নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে তর্ক করতে চাচ্ছি না। আমি একটা কাজ করছি। যদি কখনো সুযোগ হয় পরে কথা হবে।
‘জি আচ্ছা, স্যার।’
আমি আসাদুল্লাহ সাহেবের ঘরে ঢুকে পড়লাম । এই ঘর আগের মতোই আছে। একটুও বদলায়নি। খাটে শুয়ে থাকা মানুষটা শুধু বদলেছে। ভরাট স্বাস্থ্যের সেই মানুষ নেই। রোগাভোগা একজন মানুষ। মাথাভরতি চুল ছিল ল কমে গেছে। চোখের তীব্র জ্যোতিও ম্লান। নিজের তৈরি বেহেশতে জীবনযাপন করতে করতে তিনি সম্ভবত ক্লান্ত।
আসাদুল্লাহ সাহেব বললেন, কেমন আছ হিমু?
‘ভালো।’
‘তোকে দেখে আমার ভালো লাগছে।’
‘আপনাকে দেখে আমার তেমন ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।’
‘স্বর্গেবাস করা ক্লান্তিকর ব্যাপার হিমু। আমি আসলেই ক্লান্ত । সময় কাটছে না ।’
‘সময় কাটছে না কেন?’
‘কীভাবে সময় কাটাব সেটা বুঝতে পারছি না। এখন বই পড়তে পারি না।’
‘বই পড়তে পারেন না?’
‘না। বই পড়তে ভালো লাগে না, গান শুনতে ভালো লাগে না, শুয়ে থাকতে ভালো লাগে না। যা ভালো লাগে না, তা করি না। বই পড়ি না, গান শুনি না। কিন্তু শুয়ে থাকতে ভালো না লাগলেও শুয়ে থাকতে হচ্ছে। আই হ্যাভ নো চয়েস। তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন হিমু, বসো। আমার বিছানায় বসো ।’
আমি বসলাম। আসাদুল্লাহ সাহেব মুখ টিপে খানিকক্ষণ মিটমিট করে হাসলেন । কেন হাসলেন ঠিক বোঝা গেল না । হঠাৎ মুখ থেকে হাসি মুছে ফেলে গম্ভীর গলায় বললেন– এখন আমি কী করছি জান?
‘জি না, জানি না। আপনি বলুন, আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছি।’
‘আমি যা করছি তা হচ্ছে মানসিক গবেষণা ।’
‘সেটা কী?’
‘মনে মনে গবেষণা। কোনো-একটা বিষয় নিয়ে জটিল সব চিন্তা করছি, কিন্তু সবই মনে মনে। আমার সাম্প্রতিক গবেষণার বিষয় হলো- নারী-পুরুষ সম্পর্ক।’
‘প্রেম?’
‘হ্যাঁ, প্রেম । হিমু, তুমি কখনো কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছ?’
‘না ।’
‘মেয়েরা তোমার প্রেমে পড়েছে?’
‘না।’
‘তুমি নিশ্চিত?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চিত ।’
আসাদুল্লাহ সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, প্রেম সম্পর্কে তোমার ধারণাটা কী বলো ।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমি তো এইসব নিয়ে গবেষণা করছি না, কাজেই বলতে পারছি না। আপনি বরং বলুন গবেষণা করে কী পেয়েছেন।
“শুনতে চাও?’
‘হ্যা, চাই।’
আসাদুল্লাহ সাহেব বুকের নিচে বালিশ দিয়ে একটু উঁচু হলেন । কথা বলা শুরু করলেন শান্ত ভঙ্গিতে এবং খুব উৎসাহের সঙ্গে।
‘হিমু শোনো, গবেষণা না- শয্যাশায়ী মানুষের ব্যক্তিগত চিন্তা। চিন্তাও ঠিক না- ফ্যান্টাসি। আমার মনে হয় কী জান? সৃষ্টিকর্তা বা প্রকৃতি প্রতিটি ছেলেমেয়েকে পাঁচটি অদৃশ্য নীলপদ্ম দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান। এই নীলপদ্মগুলি হলো- প্রেমভালোবাসা। যেমন ধরো তুমি । তোমাকে পাঁচটি নীলপদ্ম দিয়ে পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত তুমি কাউকে পাওনি যাকে পদ্ম দিতে ইচ্ছে করেছে। কাজেই তুমি কারোর প্রেমে পড়নি। আবার ধরো, একটা সতেরো বছরের তরুণীর সঙ্গে তোমার পরিচয় হলো । মেয়েটির তোমাকে এতই ভালো লাগলো যে, সে কোনোদিকে না তাকিয়ে ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে তার সবকটি নীলপদ্ম তোমাকে দিয়ে দিল । তুমি পদ্মগুলি নিলে, কিন্তু তাকে গ্রহণ করলে না। পরে এই মেয়েটি কিন্তু আর কারও প্রেমে পড়তে পারবে না । সে হয়তো একসময় বিয়ে করবে, তার স্বামীর সঙ্গে ঘর-সংসার করবে, কিন্তু স্বামীর প্রতি প্রেম তার থাকবে না ।’
আমি বললাম, আর আমার কী হবে? আমার নিজের পাঁচটি নীলপদ্ম ছিল, তার সঙ্গে আরও পাচটি যুক্ত হয়ে পদ্মের সংখ্যা বেড়ে গেল না?
‘হ্যা, বাড়ল ।’
‘তা হলে আমি কি ইচ্ছা করলে এখন কাউকে পাচটির জায়গায় দশটি পদ্ম দিতে পারি?’
‘তা পার না। অন্যের পদ্ম দেয়া যাবে না। তোমাকে যে-পাঁচটি দেয়া হয়েছে শুধু সেই পাঁচটি দেয়া যাবে।’
‘পাঁচটি কেন বলেছেন? পাঁচের চেয়ে বেশি নয় কেন?’
‘পাঁচ হচ্ছে একটা ম্যাজিক-সংখ্যা। এইজন্যেই বলছি পাঁচ । আমাদের ইন্দ্রিয় পাঁচটি। বেশিরভাগ ফুলের পাপড়ি থাকে পাঁচটি। পাঁচ হচ্ছে একটি মৌলিক সংখ্যা । তবে পাঁচের ব্যাপারটা আমার কল্পনা, পাঁচের জায়গায় সাতও হতে পারে। আমার হাইপথিসিস তোমার কাছে কেমন লাগছে?’
‘চমৎকার লাগছে।’
‘আজকাল আমি দিনরাত এটা নিয়েই ভাবি। আমার কাছে মনে হয় পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ নীলপদ্ম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, দেয়ার মানুষ পায় না।’
‘”অনেকে হয়তো দিতেও চায় না।’
‘হ্যাঁ, তাও হতে পারে। অনেকে পদ্মগুলি হাতছাড়া করতে চায় না। আবার এমনও হতে পারে, পদ্মগুলি দেয়া হয় ভুল মানুষকে । যাকে দেয়া হলো সে পদ্মের মূল্যই বুঝল না। এই হচ্ছে আমার নীলপদ্ম থিওরি। তোমাকে বললাম, তুমি তো নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াও, অনেকের সঙ্গে মেশ, আমার থিওরিটা পরীক্ষা করে দেখো।’

‘জি আচ্ছা। তবে আমার কী মনে হয় জানেন? আমার মনে হয়, কিছু-কিছু রহস্যময় ব্যাপার সম্পর্কে কোনো থিওরি না দেয়াই ভালো। থিওরি বা হাইপোথিসিস রহস্য নষ্ট করে। থাকুক-না কিছু রহস্য। সন্ধ্যাবেলা সূর্য ডোবে, সকালে ওঠে। কত রহস্যময় একটা ব্যাপার। কিন্তু পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্যে এটা হচ্ছে জানার পর আর রহস্য থাকে না।’
‘হিমু, তুমি কি জ্ঞানের বিপক্ষে?’
‘জি। জ্ঞান একধরনের বাধা। একধরনের অন্ধকার। কোনো বিষয় সম্পর্কে পূর্বজ্ঞান নেই বিষয়টি সম্পর্কে আমদের দূরত্ব তৈরি করিয়ে দেয়।’
‘বুঝতে পারছি না।’
‘যেমন ধরুন, আপনার নীলপদ্ম থিওরি। এটা জানার পর থেকে আমার কী হবে জানেন? কোনো মেয়ের সঙ্গে দেখা হলেই আমি ভাবব, আচ্ছা, এই মেয়েটিকে কি নীলপদ্ম দেয়া যায়? দেয়া গেলে কটা দেয়া যায়? মেয়েটি তার নিজের নীলপদ্মগুলি কী করেছে? কাউকে দিয়ে ফেলেছে?’
‘আমার হাইপথিসিস তুমি এত সিরিয়াসলি নিচ্ছ কেন? তোমাকে তো আগেই বলেছি এসব আর কিছুই না, একজন অসুস্থ শয্যাশায়ী মানুষের ব্যক্তিগত প্ৰলাপ।’
আসাদুল্লাহ সাহেব হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিলেন। সিগারেট ধরিয়ে চিন্তিত মুখে টানতে লাগলেন। আমি বললাম, আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আজ আমি আসি ।
আসাদুল্লাহ সাহেব বললেন, তোমার কি মারিয়ার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
‘জি না ।’
‘মারিয়া বাসাতেই আছে। নিজের ঘরে বসে আছে। ও কারও সঙ্গেই দেখা করে না, কথা বলে না। এমনকি আমার

সঙ্গেও না ।’
‘তাই নাকি?’
‘তুমি যাবার আগে অবশ্যই তার সঙ্গে দেখা করে যাবে।’
‘কারও সঙ্গেই যখন দেখা করে না— আমার সঙ্গেও করবে না।’
আসাদুল্লাহ সাহেব হাসলেন । পুরানো দিনের সেই চমৎকার হাসি। আমি চমকে উঠলাম ।
‘হিমু!’
‘জি?’
‘আমি আমার নীলপদ্ম থিওরি মারিয়াকে দেখে দেখেই তৈরি করেছি। মারিয়া তার জীবনের প্রথম প্রেমপত্রটি তোমাকে

লেখে। খুব অল্প বয়সে লেখে। কাজেই আমার থিওরি অনুযায়ী তার সবকটা নীলপদ্ম তোমার কাছে।’
‘চিঠি লেখার ব্যাপারটি আপনি জানেন?’
‘হ্যাঁ, জানি। আমার মেয়ের সঙ্গে আমার চুক্তি ছিল, সে তার জীবনের প্রথম প্রেমপত্রটি আমাকে দেখিয়ে লিখবে ।

মারিয়া চুক্তি রক্ষা করেছে। আমাকে চিঠিটি দেখিয়েছে, তবে আমি যেন বুঝতে না পারি সেজন্যে ছেলেমানুষি এক সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করেছে ।’
‘আপনি সেই সাংকেতিক চিঠির সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলেছেন?’
‘অবশ্যই। তবে ভান করেছি ত পারিনি।’
মারিয়া সেই চিঠি কাকে লিখেছিল তা কি আপনাকে বলেছে?’
‘না। তবে আমি অনুমান করেছি। আমার অনুমানশক্তি খারাপ না । হিমু শোনো, আমার মেয়েটা পড়াশোনার জন্যে

ইংল্যান্ড চলে যাচ্ছে। আমি নিজেই জোর করে পাঠিয়ে দিচ্ছি। মনের যে-শক্তি মানুষকে চালিত করে আমার মেয়েটার মনের সেই শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। ওকে সেই শক্তি ফেরত দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কাজটা আমি তোমাকে দিয়ে করাতে চাই। এইজন্যেই তোমাকে এত ব্যস্ত হয়ে খুঁজছি।’
‘মনের শক্তি জাগানোর কাজটা আপনি করতে পারছেন না কেন?’
‘আমার উপর মেয়েটির যে-বিশ্বাস ছিল সেই বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে।’
‘কেন?’
আসাদুল্লাহ সাহেব আরেকটা সিগারেট ধরালেন। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, তুমি কি লক্ষ্য করেছ মারিয়ার মা’র নখে এক ভদ্রলোক নেলপলিশ লাগাচ্ছেন?
‘হ্যাঁ, লক্ষ্য করেছি।’
‘নেলপালিশের এই এক্সপেরিমেন্ট অনেকদিন ধরেই করা হচ্ছে । মারিয়ার মা ঐ ভদ্রলোকের প্রেমে পড়েছে। তারা শিগগিরই বিয়ে করবে। আমি সব জেনেও কিছু বলছি না। মারিয়া এতেও আহত হয়েছে। জীবনে সে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে।’
‘আমাকে কী করতে বলেন?’
‘ওকে জীবনের জটিলতার অংশটার কথা বুঝিয়ে বলো। ও তোমার কথা শুনবে, কারণ ওর নীলপদ্মগুলি তোমার কাছে।’

.

মারিয়া বলল, বসুন।
তার চোখমুখ কঠিন, তবু মনে হলো সেই কাঠিন্যের আড়ালে চাপা হাসি ঝিকমিক করছে। সে সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে। চাপা রঙের শাড়ি । রঙটা এমন যে মনে হচ্ছে ঘরে চাপাফুলের গন্ধ পাচ্ছি। গলায় লাল পাথর। চুনি নিশ্চয় না। চুনি এত বড় হয় না।
‘রকিং-চেয়ারে আরাম করে বসে দোল খেতে খেতে কথা বলুন। বাবা আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন, তা-ই তো?’
আমি দোল খেতে খেতে বললাম, হ্যাঁ।
‘বাবার ধারণা, আমার মন খুব অশান্ত । সেই অশান্ত মন শান্ত করার সোনার কাঠি আপনার কাছে। তা-ই না?’
‘এরকম ধারণা ওনার আছে বলেই তো মনে হচ্ছে!’
‘এরকম অদ্ভুত ধারণার কারণ জানেন?’
‘না।’
‘কারণটা আপনাকে বলি–অ্যাকসিডেন্টের পর বাবা মানসিক দিক থেকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তখন তাকে কিছু কথা বলেন। তাতে তার মন শান্ত হয় । সেই থেকেই বাবার ধারণা হয়েছে মন শান্ত করার মতো কথা আপনি বলতে পারেন। ভালো কথা, বাবাকে আপনি কী বলেছিলেন?’
‘আমার মনে নেই। উদ্ভট কথাবার্তা তো আমি সবসময়ই বলি। তাকেও মনে হয় উদ্ভট কিছুই বলেছিলাম।’ ‘আমাকেও তা হলে উদ্ভট কিছু বলবেন?’
‘তোমাকে উদ্ভট কিছু বলব না। তুমি আমাকে যে-চিঠি লিখেছিলে আমি তার জবাব লিখে এনেছি। সাংকেতিক ভাষায় লিখে এনেছি।’ মারিয়া হাত বাড়াল। তার চোখে চাপা কৌতুক ঝকমক করছে। মনে হচ্ছে যেকোনো মুহুর্তে সে খিলখিল করে হেসে ফেলবে। যেন সে অনেক কষ্টে হাসি থামাচ্ছে।
‘সাংকেতিক চিঠিটায় কী লেখা পড়তে পারছ?’

‘পারছি এখানে লেখা I hate you.’
‘I love you-ও তো হতে পারে।”সংকেতের ব্যাখ্যা সবাই তার নিজের মতো করে করে, আমিও তা-ই করলাম । আপনার আটটা তারার অনেক মানে করা যায়, যেমন
I want you.
I miss you.
I lost you.
আমি আমার পছন্দমতো একটা বেছে নিলাম।’
‘মারিয়া, তোমার এই ঘরে কি সিগারেট খাওয়া যায়?’
‘যায় না, কিন্তু আপনি খেতে পারেন।’
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, তুমি কি তোমার বাবার নীলপদ্ম থিওরির কথা জান?
মারিয়া এইবার হেসে ফেলল। কিশোরীর সহজ স্বচ্ছ হাসি। হাসতে হাসতে বলল, আজগুবি থিওরি। আজগুবি এবং হাস্যকর।
‘হাস্যকর বলছ কেন?’

‘হাস্যকর এইজন্যে বলছি যে, বাবার থিওরি অনুসারে আমার পাঁচটি নীলপদ্ম এখন আপনার কাছে। কিন্তু আমি আপনার প্রতি কোনো আকর্ষণ বোধ করছি না। আপনাকে দেখে কোনোরকম আবেগ, রোমাঞ্চ কিছুই হচ্ছে না। বরং কিশোরী বয়সে যে পাগলামিটা করেছিলাম তার জন্যে রাগ লাগছে। বাবার থিওরি ঠিক থাকলে কিশোরী বয়সে পাগলামির জন্যে এখন রাগ লাগত না ।’
‘এখন পাগলামি মনে হচ্ছে?’
‘অবশ্যই মনে হচ্ছে। হিমু ভাই, আমি সেই সময় কীসব পাগলামি করেছি একটু শুনুন। চা খাবেন?’
‘না ।’
‘খান একটু। আমি খাচ্ছি, আমার সঙ্গে খান। বসে থাকুন, আমি চা নিয়ে আসছি।’
মারিয়া বের হয়ে গেল। আমি নিজের মনে দোল খেতে লগলাম। দীর্ঘ পাঁচ বছরে মারিয়ার ঘরে কী কী পরিবর্তন হয়েছে তা ধরার চেষ্টাও করছি। ধরতে পারছি না। একবার মনে হচ্ছে ঘরটা ঠিক আগের মতো আছে, আবার মনে হচ্ছে একেবারেই আগের মতো নেই। সবই বদলে গেছে। মারিয়ার ছোটবেলাকার ছবিটা শুধু আছে। ছবি বদলায় না ।
মারিয়া ট্রেতে করে মগভরতি দু’মগ চা নিয়ে ঢুকল। কোনো কারণে সে বোধহয় খুব হেসেছে। তার ঠোঁটে হাসি লেগে আছে।
‘হিমু ভাই, চা নিন।’
আমি চা নিলাম। মারিয়া হাসতে হাসতে বলল, জামিল চাচার সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়েছে?
‘নখ-শিল্পী?’
‘হ্যাঁ, নখ-শিল্পী। মা’র নখের শিল্পকর্ম তিনি কিছুক্ষণ আগে শেষ করেছেন। মা সেই শিল্পকর্ম দেখে বিস্ময়ে অভিভূত।’
‘খুব সুন্দর হয়েছে?’
‘দেখে মনে হচ্ছে নখে ঘা হয়েছে- রক্ত পড়ছে। মা’কে এই কথা বলায় মা খুব রাগ করল। মা’র রাগ দেখে আমার হাসি পেয়ে গেল। মা যত রাগ করে আমি তত হাসি । হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে গেছে। চায়ে চিনি-টিনি সব ঠিক হয়েছে?’
‘হয়েছে।’
‘বাবার সঙ্গে মা’র কীভাবে বিয়ে হয়েছিল সেটা কি আপনি জানেন?’
‘না, জানি না। ঐ গল্প থাক— তোমার গল্পটা বলো। কিশোরী বয়সে কী পাগলামি করলে?’

‘আমার গল্পটা বলছি, কিন্তু মা’র গল্পটা না শুনলে আমারটা বুঝতে পারবেন না। মা হচ্ছেন বাবার খালাতে বোন। মা যখন ইন্টারমিডিয়েট পড়তেন তখন বাবার জন্যে মা’র মাথা-খারাপের মতো হয়ে গেল। বলা চলে পুরো উন্মাদিনী অবস্থা। বাবা সেই অবস্থাকে তেমন পাত্তা দিলেন না। মা কিছু ডেসপারেট মুভ নিলেন। তাতেও লাভ হলো না। শেষে একদিন বাবাকে দীর্ঘ একটা চিঠি লিখে সিনেমার প্রেমিকাদের মতো একগাদা ঘুমের অষুধ খেয়ে ফেললেন। মা’র জীবনসংশয় হলো। এখন মরে-তখন মরে অবস্থা। বাবা হাসপাতালে মা’কে দেখতে গেলেন। মা’র অবস্থা দেখে তার করুণা হলো। বাবা হাসপাতালেই ঘোষণা করলেন-মেয়েটা যদি বাঁচে তাকে বিয়ে করতে আমার কোনো আপত্তি নেই। মা বেঁচে গেলেন। তদের বিয়ে হলো। গল্পটা কেমন?’
‘ইন্টারেস্টিং।’
‘ইন্টারেস্টিং না, সিনেমাটিক । ক্লাসিক্যাল লাভ ক্টোরি । প্রেমিককে না পেয়ে আত্মহননের চেষ্টা। এখন হিমু ভাই, আসুন, মা’র ক্ষেত্রে বাবার নীলপদ্ম থিওরি অ্যাপ্লাই করি। থিওরি অনুযায়ী মা তাঁর নীলপদ্মগুলি বাবাকে দিয়েছিলেন- সবক’টা দিয়ে দিয়েছিলেন। তা-ই যদি হয় তা হলে পড়ন্ত যৌবনে মা জামিল চাচাকে দেয়ার জন্যে নীলপদ্ম পেলেন কোথায়? জামিল চাচা বিবাহিত একজন মানুষ। তাঁর বড় মেয়ে মেডিকেলে পড়ছে। তিনি যখন-তখন এ-বাড়িতে আসেন। মা’র শোবার ঘরে দুজনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করেন। শোবার ঘরের দরজাটা তারা পুরোপুরি বন্ধও করেন না, আবার খোলাও রাখেন না। সামান্য ফাঁক করে রাখেন। মজার ব্যাপার না?’
আমি কিছুই বললাম না। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে মারিয়ার হাসিহাসি মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম ।
‘হিমু ভাই!’
‘বলো ।’
‘বাবার নীলপদ্মবিষয়ক হাস্যকর ছেলেমানুষি থিওরির কথা আমাকে বলবেন না।’
‘আচ্ছা বলব না!’
‘প্রেম নিতান্তই জৈবিক একটা ব্যাপার- নীলপদ্ম বলে একে মহিমান্বিত করার কিছু নেই।’
‘তাও স্বীকার করছি।’
‘হিমু ভাই, আপনি এখন বিদেয় হোন- আপনার চা আশা করি শেষ হয়েছে।’
‘হ্যাঁ, চা শেষ।”আমাকে নিয়ে বাবার দুশ্চিন্তা করার কিছুই নেই। বাবার কাছে শুনেছেন নিশ্চয়ই, আমি বাইরে পড়তে চলে যাচ্ছি। এখানকার কোনোকিছু নিয়েই আর আমার মাথাব্যথা নেই। বাবার সময় কাটছে না, সেটা তার ব্যাপার। আমি দেখব আমার নিজের জীবন, আমার কেরিয়ার!’

‘খুবই ভালো কথা ।’
আমি উঠে দাঁড়ালাম। মারিয়া বলল, ও আচ্ছা, আরও কয়েক মিনিট বসুন, আপনাকে নিয়ে কীসব পাগলামি করেছি তা বলে নিই। আপনার শোনার শখ ছিল ।
আমি বসলাম। মারিয়া আমার দিকে একটু ঝুঁকে এল । দামি কোনো পারফিউম সে গায়ে দিয়েছে। পারফিউমের হালকা সুবাস পাচ্ছি। হালকা হলেও সৌরভ নিজেকে জানান দিচ্ছে কঠিনভাবেই। মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। মারিয়ার চুল খোলা। এই খোলা চুল ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। কিছু এসে পড়ছে আমার মুখে। ভয়াবহ সুন্দর একটি দৃশ্য।
‘হিমু ভাই!’
‘বলো!’
‘একটা সময়ে আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। ভয়ংকর কষ্টের কিছু সময় পর করেছি। রাতে ঘুম হতো না। রাতের পর রাত জেগে থাকার জনেই হয়তো মাথাটা খানিকটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। অদ্ভুত অদ্ভুত সব ব্যাপার হতো। অনেকটা হ্যালুসিনেশনের মতো। মনে করুন পড়তে বসেছি, হঠাৎ মনে হলো আপনি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমার বই-এ আপনার ছায়া পড়েছে। তখন বুক ধকধক করতে থাকত। চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখতাম— কেউ নেই। আপনাকে তখনই চিঠিটা লিখি। আপনি তার জবাব দেননি। আমাদের বাড়িতে আর আসেনওনি।’
‘না এসে ভালোই করেছি। তোমার সাময়িক আবেগ যথাসময়ে কেটে গেছে। তুমি ভুল ধরতে পেরেছ।’ ‘হ্যাঁ, তা পেরেছি। ঐ সময়টা ভয়ংকর কষ্টে কষ্টে গেছে। রোজ ভাবতাম, আজ আপনি আসবেন । আপনি আসেননি। আপনার কোনো ঠিকানা নেই আমাদের কাছে যে আপনাকে খুঁজে বের করব। আমার সে-বছর এ লেভেল পরীক্ষা দেবার কথা ছিল । আমার পরীক্ষা দেয়া হয়নি। প্রথমত, বই নিয়ে বসতে পারতাম না। দ্বিতীয়ত, আমার মনে হতো আমি পরীক্ষা দিতে যাব আর আপনি এসে আমাকে না পেয়ে ফিরে যাবেন । আমি রোজ রাতে দরজা বন্ধ করে কাঁদতাম।’
বলতে বলতে মারিয়া হাসল। কিন্তু তার চোখে অনেকদিন আগের কান্নার ছায়া পড়ল। এই ছায়া সে হাসি দিয়ে ঢাকতে পারল না ।
আমি বললাম, তার পরেও তুমি বলছ নীলপদ্ম কিছু না- পুরো ব্যাপারটাই জৈবিক?
‘হ্যাঁ, বলছি। তখন বয়স অল্প ছিল। তখন বুঝতে পারিনি, এখন বুঝছি। চারপাশে কী ঘটছে তা দেখে শিখছি।’
আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে খুবই দুঃখিত।
‘চলে যাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ।’
‘আপনার চিঠি নিয়ে যান। আট তারার চিঠি । এই হাস্যকর চিঠির আমার দরকার নেই।’
আমি চিঠি নিয়ে পকেটে রাখলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, আসাদুল্লাহ সাহেবের নীলপদ্ম থিওরি ঠিক আছে। এই তরুণী তার সমস্ত নীলপদ্ম হিমু নামের এক ছেলের হাতে তুলে দিয়ে তীব্র কষ্ট ও যন্ত্রণার ভেতর বাস করছে। এই যন্ত্রণা, এই কষ্ট থেকে তার মুক্তি নেই। আমি তাকালাম মারিয়ার দিকে। সে এখন মাথা নিচু করে বসে আছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। অশ্রু গোপন করার জন্যে মেয়েরা ঐ ভঙ্গিটা মাঝে মাঝে ব্যবহার করে।
‘মারিয়া!’
‘জি?’
‘ভালো থেকো ।’
‘আমি ভালোই থাকব ।’
‘যাচ্ছি, কেমন?’
‘আচ্ছা যান। আমি যদি বলি- আপনি যেতে পারবেন না, আপনাকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে- আপনি কি থাকবেন? থাকবেন না। কাজেই যেতে চাচ্ছেন, যান।
‘গেট পর্যন্ত এগিয়ে দাও।’
‘না। ও আচ্ছা, আমার হাতটা দেখে দিয়ে যান। আমার ভবিষ্যৎটা কেমন হবে বলে দিয়ে যান ।’
মারিয়া তার হাত এগিয়ে দিল । মরিয়ার হাত দেখার জন্যে আমি আবার বসলাম।
‘খুব ভালো করে দেখবেন। বানিয়ে বানিয়ে বলবেন না।’
‘তোমার খুব সুখের সংসার হবে। স্বামী-স্ত্রী এবং একটি কন্যার অপূর্ব সংসার। কন্যাটির নাম তুমি রাখবে- চিত্ৰলেখা।’
মারিয়া খিলখিল করে হাসতে হাসতে হাত টেনে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলল–থাক, আপনাকে আর হাত দেখতে হবে না। বানিয়ে বানিয়ে উদ্ভট কথা! আমি আমার মেয়ের নাম চিত্ৰলেখা রাখতে যাব কেন? দেশে নামের আকাল পড়েছে যে বাড়ির নামে মেয়ের নাম রাখব? যা-ই হোক, আমি অবিশ্যি ভবিষ্যৎ জানার জন্য আপনাকে হাত দেখতে দিইনি। আমি আপনার হাত কিছুক্ষণের জন্য ধরতে চাচ্ছিলাম। এম্নিতে তো আপনি আমার হাত ধরবেন না, কাজেই অজুহাত তৈরি করলাম। হিমু ভাই, আপনি এখন যান। প্রচণ্ড রোদ উঠেছে, রোদে আপনার বিখ্যাত হাটা শুরু করুন।
মারিয়ার গলা ধরে এসেছে। সে আবার মাথা নিচু করে ফেলেছে। কয়েক মুহুর্তের প্রয়োজন নেই। মহাপুরুষ না, সাধারণ মানুষ হয়ে মমতাময়ী এই তরুণীটির পাশে এসে বসি । যে-নীলপদ্ম হাতে নিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম, সেই পদ্মগুলি তার হাতে তুলে দিই। তার পরই মনে হলো- এ আমি কী করতে যাচ্ছি। আমি হিমু— হিমালয়।
মারিয়া বলেছিল সে গেট পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দিতে আসবে না। কিন্তু সে এসেছে। গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের ভেতর মনে হচ্ছিল মারিয়া চাঁপা রঙের শাড়ি পরে আছে, এখন দেখি শাড়ির রঙ নীল। রোদের আলোয় রঙ বদলে গেল, নাকি প্রকৃতি আমার ভেতর বিভ্রম তৈরি করা শুরু করেছে?

‘হিমু ভাই!’
‘বলো ।’
‘যাবার আগে আপনি কি বলে যাবেন আপনি কে?’
আমি বললাম, মারিয়া, আমি কেউ না। I am nobody ৷
আমি আমার এক জীবনে অনেককে এই কথা বলেছি- কখনো আমার গলা ধরে যায়নি, বা চোখ ভিজে ওঠেনি। দুটা ব্যাপারই এই প্রথম ঘটল ।
মারিয়া হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
প্রচণ্ড রোদে আমি হাঁটছি। ঘামে গা ভিজে চপচপে হয়ে গেছে। বড় রাস্তায় এসে জামের ভেতর এসে পড়লাম। কার যেন বিজয়-মিছিল বের হয়েছে। জাতীয় পার্টির মিছিল। ব্যানারে এরশাদ সাহেবের ছবি আছে। আন্দোলনের শেষে সবাই বিজয়-মিছিল করছে, তারাই-বা করবে না কেন? এই প্রচণ্ড রোদেও তাদের বিজয়ের আনন্দে ভাটা পড়ছে না। দলের সঙ্গে ভিড়ে যাব কি না ভাবছি। একা হাঁটতে ইচ্ছা করছে না। মিছিলের সঙ্গে থাকায় একটা সুবিধা হচ্ছে অনেকের সঙ্গে থেকেও একা থাকা যায়।
কিছুক্ষণ হাঁটলাম মিছিলের সঙ্গে। একজন আমার হাতে এরশাদ সাহেবের একটা ছবি ধরিয়ে দিল । এরশাদ সাহেবের আনন্দময় মুখের ছবি। প্রচণ্ড রোদে সেই হাসি স্নান হচ্ছে না।
মিছিল কাওরান বাজার পার হলো । আমরা গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিতে দিতে এগুচ্ছি- পল্লীবন্ধু এরশাদ। জিন্দাবাদ!
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, আমার পা-খোড়া কুকুরটা আমার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। কাওরান বাজার তার এলাকা । সে আমাকে দেখতে পেয়ে নিঃশব্দে আমার পাশে পাশে চলা শুরু করেছে। তার খোড়া পা মনে হচ্ছে পুরোপুরি অচল- এখন আর মাটিতে ফেলতে পারছে না। তিন পায়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। আমি বললাম, তিন পায়ে হাঁটতে তোর কষ্ট হচ্ছে না তো?
সে বলল, কুঁই কুঁই কুঁই ।

কী বলতে চেষ্টা করল কে জানে কুকুরের ভাষা জানা থাকলে সুবিধা হতো। আমার জানা নেই, তার পরেও আমি তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগুচ্ছি —
‘তুই যে আমার সঙ্গে আসছিস আমার খুব ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে খুব একা লাগে, বুঝলি? আমার সঙ্গে কী আছে জানিস? পদ্ম-নীলপদ্ম! পাঁচটা নীলপদ্ম নিয়ে ঘুরছি। কী অপূর্ব পদ্ম কাউকে দিতে পারছি না। দেয়া সম্ভব নয়। হিমুরা কাউকে নীলপদ্ম দিতে পারে না ।’

চৈত্রের রোদ বাড়ছে। রোদটাকে আমি জোছনা বানানোর চেষ্টা করছি। বানানো খুব সহজ- শুধু ভাবতে হবে- আজ গৃহত্যাগী জোছনা উঠেছে- চারদিকে থৈথৈ করছে জোছনা । ভাবতে ভাবতেই একসময় রোদটাকে জোছনার মতো মনে হতে থাকবে । আজ অনেক চেষ্টা করেও তা পারছি না। ক্লান্তিহীন হাটা হেঁটেই যাচ্ছি- হেঁটেই যাচ্ছি।

(সমাপ্ত)

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments