Friday, March 29, 2024
Homeবাণী-কথাঅনুবাদ গল্পনরখাদক - মার্ক টোয়েন

নরখাদক – মার্ক টোয়েন

Cannibalism In The Cars

ইন্ডিয়ানার টেরি হটেতে (Terre Haute) ট্রেন বদল করে পশ্চিমমুখী এগুচ্ছি, যাব সেন্ট লুই (St. Louis)। পথের পাশের কোনো স্টেশন থেকে এক ভদ্রলোক উঠে এসে আমার পাশে বসলেন, সারা মুখে দয়ালু-ভাব। বয়েস বছর পঁয়তাল্লিশেক, হয়তো পঞ্চাশও হতে পারে। ঘণ্টাখানেক নানা বিষয়ে আলোচনা করে বুঝলাম, ভদ্রলোক সদালাপী আর বেশ বুদ্ধিমান। আমি ওয়াশিংটনে থাকি জানতে পেরে তক্ষুনি একাধিক সেনানায়ক আর কংগ্রেসের ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। বুঝতে দেরি হল না যে, এমন একজনের সাথে কথা বলছি—রাজনৈতিক জীবনের নাড়ি-নক্ষত্র, এমনকি জাতীয় আইনসভার রীতি-নীতি সম্পর্কেও তিনি ওয়াকিবহাল।

দু-জন লোক এগিয়ে যাচ্ছিল আমাদের পাশ দিয়ে। মুহুর্তখানেক থামল তারা। একজন তার সাথিকে বলল, ‘হ্যারিস, ও-কাজটা করে দিলে সারাজীবন তোমার কথা মনে থাকবে।’

আমার নতুন-চেনা বন্ধুর চোখ আনন্দে নেচে উঠল। মনে হয়, কোনো সুখকর স্মৃতির প্রতিফলন পড়েছে তার মনের পর্দায়। তারপরই মিলিয়ে গেল সে ভাব। বলতে গেলে বিষাদের ছায়াই নেমে এল তার মুখে। আমার দিকে ফিরে বললেন, আপনাকে একটা গল্প শোনাচ্ছি। এটা আমার জীবনের এক গোপন অধ্যায়–আর কাউকেই কোনোদিন বলা হয়নি। এ-গল্প ধৈর্য ধরে শুনুন, তবে তার আগে কথা দিন যে, আমাকে বাধা দেবেন না।

সে প্রতিশ্রতি আমি দিলাম। তারপর তিনি বললেন নিচের গল্পটি—গলার স্বরে কখনো হিংস্রতা, কখনো বিষাদক্লিষ্টতা, তবু অনুভূতি আর আন্তরিকতায় গাঢ় সেই স্বর।

‘তারিখটা ১৮৫৩ সালের ২৯শে ডিসেম্বর। সন্ধের গাড়িতে সেন্ট লুই থেকে শিকাগো রওনা দিয়েছি। গাড়িতে সব মিলিয়ে চব্বিশ জন যাত্রী আমরা, নারী বা শিশু নেই একজনও। খোশমেজাজে চলেছি সকলে, কাজেই আলাপ-পরিচয় আর খোশগল্প শুরু হতেও দেরি হল না। সব মিলিয়ে শুভযাত্রারই লক্ষণ। ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবতে পারেন নি যে, কী বিপদ ওঁত পেতে আছে সামনে।

রাত এগারোটার দিকে প্রচণ্ড তুষারপাত শুরু হল। ছোট গ্রাম ওয়েল্ডন ছাড়িয়ে যাবার একটু পরেই আমরা পড়লাম এই ভয়াবহ প্রেইরিতে। জুবিলি উপনিবেশ পর্যন্ত মাইলের পর মাইল বিস্তৃত এই রিক্ত প্রান্তরে জনমানব বা ঘরবাড়ির চিহ্নটি নেই। বুঝে দেখুন, পাহাড়টিলা, গাছপালা, এমনকি ছুটকো-ছাটকা পাথরের বাধাও না থাকায় কী সাংঘাতিক জোরে বাতাস বইছিল আর তুষারকে ঠেঙিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। ক্রমেই গাঢ় হয়ে জমেছে বরফ। ক্রমেই শ্লথ হয়ে আসা ট্রেনের গতি থেকে বুঝতে পারছি, খুব কষ্ট করে পথ করে নিতে হচ্ছে ইঞ্জিনকে। মাঝে মাঝে একেকবার প্রায় থেমে যাচ্ছে ট্রেন। যাত্রীদের কলগুঞ্জন স্তিমিত হয়ে এসেছে। একটু আগের খোশমেজাজের বদলে সকলেরই মন ভারি হয়ে এসেছে উদ্বেগে। চারপাশে পঞ্চাশ মাইলের ভেতর জনমানবহীন এই উষর প্রান্তরে বরফে আটকা পড়ে যাবার আশঙ্কায় সকলেই চিন্তাকুল। এই অস্বস্তির ভেতরেও তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। রাত-দুটোয় ঘুম ভেঙে যেতেই ঘুম ভাঙার কারণটা টের পেলাম। আশপাশের সব গতি স্তব্ধ হয়ে গেছে। ভয়াবহ সত্যটা মুহুর্তের ভেতরই মনের ভেতরটায় কাপন দিয়ে গেল। জমাট বরফে আটকা পড়ে গেছি আমরা।’

‘সবাই হাত লাগান, পথ পরিষ্কার করতে হবে–সবাই!’ চড়া গলায় কার যেন আদেশ ভেসে এল।

তড়াক করে লাফিয়ে উঠল সকলে। মিশকালো আঁধারে মুষল তুষারপাতের সেই উদ্দাম রাতে লাফিয়ে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। শাবল, কাঠের টুকরো এমনকি খালি হাতে পর্যন্ত লেগে গেল সবাই বরফ সরাতে। সে-দৃশ্য বর্ণনার বাইরে। ছোট্ট একদল মানুষ কেউ জমাট আঁধারে, কেউ-বা ইঞ্জিনের অস্পষ্ট আলোয় মরিয়া হয়ে পড়ছে তাল তাল জমা বরফের বিরুদ্ধে। সকলের মনেই ঘুরছে একই কথা—মুহূর্তের বিলম্বের জন্যও আটকা পড়ে যেতে হতে পারে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। কিন্তু মাত্র ঘণ্টাখানেকের ভেতরই আমাদের চেষ্টার অসারতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়ে গেল। আমরা একতাল বরফ সরাচ্ছি, ততক্ষণে জমে গেছে আরো বার তাল। বিপদের ওপর বিপদ দেখা গেল, বরফের সাথে শেষ ধাক্কায় ইঞ্জিনের চাকার দুটো শ্যাফট ভেঙে গেছে। অবস্থা এমন যে পথ খোলা পেলেও সমান অসহায় হয়েই থাকতে হবে আমাদের। শ্রান্ত দেহে বিষন্ন মনে গাড়িতে উঠে এলাম! অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে জড়ো হয়ে নিজেদের অবস্থার পর্যালোচনায় বসলাম। করো সাথেই খাবার জিনিস নেই কিছু—সবচাইতে বিপদের কারণ এটা। অবশ্যি শীতে জমে যাবার ভয় নেই। যথেষ্ট জ্বালানি-কাঠ আছে গাড়িতে। কিন্তু এ আর কতটুকু সান্ত্বনা! শেষ পর্যন্ত কন্ডাক্টরের উপদেশ মানাই সাব্যস্ত হল। এই গাঢ় বরফে পঞ্চাশ মাইল পায়ে হেঁটে যাবার চেষ্টা করার অর্থ নিশ্চিত মৃত্যু। সাহায্যের জন্যে খবর পাঠানোও সম্ভব নয়, সম্ভব হলেও সাহায্য আসবে না। কাজেই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে আমাদের মুক্তির বা অনাহারে মৃত্যুর জন্যে আসামি যেমন করে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা শোনে, তেমনি আমাদের। ভেতরে সবচাইতে সাহসী যারা তাদেরও বুক কেঁপে উঠেছিল সেদিন।

আলাপ-আলোচনা স্তব্ধ হয়ে গেছে। বাতাসের ঝাপটার ফাকে ফাকে শুধু আভাস পাওয়া যায় মৃদু গুঞ্জনের। বাতির আলো অস্পষ্টতর হয়ে এসেছে। ভাগ্যাহত যাত্রীদের বেশির ভাগই শুয়ে পড়েছে এখানে-ওখানে, আলো-আঁধারির মাঝে। শুয়ে চিন্তা করছে, চেষ্টা করছে বর্তমানকে ভুলে থাকতে—সম্ভব হলে ঘুমুতেও।।

অনন্ত রাত-অন্তত আমাদের অনন্তই মনে হয়েছিল—পঙ্গু প্রহরগুলোকে নিয়ে গড়িয়ে চলে। একসময় পূর্বাকাশে হিমাতুর, ধূসর প্রভাতের উদয় হল। আলোর রেশ আরেকটু জোরালো হতেই একে-একে যাত্রীদের ভেতর জীবনস্পন্দন দেখা দিল। জমে-আসা হাত-পা ছড়িয়ে দিল তারা। তারপর জানালা-পথে মুখ বাড়িয়ে দেখল নিরানন্দ বাহিরকে। আসলে নিরানন্দই সে দৃশ্য। একটি প্রাণীর সাড়া নেই কোনো দিকে, নেই কোনো ঘরবাড়ির চিহ্ন। পুরু সাদা বরফের চাদরে মোড়া সীমাহীন সে মরুভূমি। বাতাসের চাবুক-খাওয়া চাপড়াগুলো উঠে আসছে–ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে এদিক-ওদিক। ফেনার মতো তুষারের ছোটাছুটিতে দেখা যায় না উপরের নীলাকাশও।

সারাটা দিন ধরে এগাড়ি-ওগাড়ি ঘুরে বেড়ালাম আমরা। কথা বলছি খুবই কম, তবু অনন্ত চিন্তার স্রোত বয়ে যাচ্ছে সকলের মনেই। তারপর আরেকটি প্রায় অনন্ত অস্বস্তিকর রাত—আর তীব্র ক্ষুধার দাহন। পরের দিন আবার সকাল হল। আরেকটি দিন কেটে গেল বাকরোধ করা বিষাদে, ক্ষুধার প্রদাহে আর অসম্ভব সাহায্যের ব্যর্থ প্রতীক্ষায়। অস্বস্তিকর তন্দ্রার রাত–মহাভোজের স্বপ্ন দেখছি, তারপর আবার জেগে উঠছি অসার করে দেওয়া ক্ষুধার ভেতরে।

চারটি দিন গেল আর এল—তারপর এল পঞ্চম দিন। পাঁচদিনের অনাহার আর বন্দিদশা! হিংস্র বুভুক্ষা তার হিংস্রতার ছাপ ফেলেছে প্রতিটি চোখে। প্রতিটি বুকে ঘোরাফেরা করছে এমন কিছু, যার ছায়া পড়েছে প্রতিটি বুকেও—তবুও সেটা এমন কিছু যা উচ্চারণ করার সাহস তখনও হচ্ছে না কারোই। ষষ্ঠ দিনও যায়। সপ্তম দিনে ভোর হল মৃত্যু-গুহায় কয়েকটি নুয়ে-পড়া দেহ আর বিবশ-মনের মানুষের ওপর। এই বুঝি বেরিয়ে পড়ে! যা এ কয়দিন সকলের মনেই ঘুরে বেড়াচ্ছিল—এবারে তা প্রকাশের বাসনায় ভর করেছে রসনাগ্রে। অনেক মাশুল বসানো হয়েছে প্রকৃতির ওপর, এবারে হাল তাকে ছাড়তেই হবে। লম্বা গড়নের অগোছালো আর বিবর্ণ লোকটা মিনেসোটার রিচার্ড এইচ গ্যাস্টন। ধীরে ধীরে উঠে দাড়ালেন তিনি। ততক্ষণে সকলের মনেই জানা হয়ে গেছে কী আসছে সামনে। তার জন্যে তৈরিও সকলে–হৃদয়াবেগ, চিত্তচাঞ্চল্যের শেষ রেশটুকু পর্যন্ত স্থির হয়ে গেছে। গত কদিন ধরে যে চোখগুলোতে ছিল হিংস্র লোলুপতা, এখন সেখানে এসেছে চিন্তার গভীরতা।

‘ভদ্রমহোদয়গণ, আর দেরি করা চলে না! সময় খুবই সংকীর্ণ। আমাদের স্থির করতে হবে—অন্যের খাবার জোগাতে কাকে কাকে প্রাণ দিতে হবে।’

ইলিওনিসের মি. জন জে উইলিয়ামস উঠে দাঁড়ালেন : ‘ভদ্রমহোদয়গণ, আমি টেনেনির রেভারেন্ড জেমস সয়্যার-এর নাম প্রস্তাব করছি।’

ইন্ডিয়ানার মি. উইলিয়াম আর এডাম্স্ বললেন : আমি প্রস্তাব করছি, নিউইয়র্কের মি, ড্যালিয়েল স্টোলের নাম।

মি. চার্লস জে ল্যাংডন : আমি সেন্ট লুই’র মি. স্যামুয়েল এ বাওয়েনকে মনোনীত করছি।
মি. স্টোল : ‘আমি নিউজার্সির মি. জন এ, ভ্যান নস্ট্রাল্ডের সপক্ষে সরে দাঁড়াচ্ছি।’
মি. গ্যাস্টন : কারো আপত্তি না থাকলে এ ভদ্রলোকের ইচ্ছেই পূর্ণ হবে।

মি. ভ্যান নস্ট্রান্ড আপত্তি করায় মি. স্টোলের পদত্যাগ নাকচ হয়ে গেল। মেসার্স সয়্যার এবং বাওয়েনও পদত্যাগের প্রস্তাব করেন। তবু একই কারণে তাদের প্রস্তাবও বাতিল হয়ে গেল।

ওহায়োর মি. এ এল ব্যাসকম : আমি প্রস্তাব করছি যে, মনোনয়ন এখানেই শেষ করা হোক—তারপর শুরু হোক ব্যালট ভোট।
মি. সয়্যার : ‘ভদ্রমহোদয়বৃন্দ, এসব কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আমি আন্তরিক প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এগুলো সবদিক থেকেই রীতি-বিরুদ্ধ এবং অশোভন। এসব কার্যবিবরণী অবিলম্বে পরিত্যাগের প্রস্তাব করতে আমি বাধ্য হচ্ছি। আমাদের উচিত একজন চেয়ারম্যান আর তাকে সাহায্য করার জন্য যথোপযুক্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা। কেবল তা হলেই আমরা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এবং পারস্পরিক সমঝোতার ভেতর দিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে পারব।

আয়োরার মি. বেল : ‘ভদ্রমহোদয়বৃন্দ—আমি আপত্তি করছি। এটা রীতি-নীতির কচকচি আর আড়ম্বরানুষ্ঠানের সময় নয়। সাতদিন ধরে পেটে দানাটি পড়েনি কারো, বাজে আলোচনায় সময় নষ্ট করে নিজেদের আরো কাহিল করে ফেলছি আমরা। এ-পর্যন্ত যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে আমার পুরোপুরি সায় আছে—আমার বিশ্বাস, সমবেত ভদ্রমহোদয়বৃন্দ, বিশেষ করে আমি নিজে তো বটেই, মনে করি যে, প্রস্তাবিতদের ভেতর আমাদের অবিলম্বে এক বা একাধিক জনকে বেছে নেওয়া উচিত। আমি প্রস্তাব করতে চাই যে—’
মি. গ্যাস্টন : এতেও আপত্তি উঠবে। নিয়মমাফিক এ-প্রস্তাব সম্পর্কে পুরো একদিন ভেবে দেখা দরকার। এতে করে বরং যে দেরি আপনি এড়াতে চেয়েছেন, সেটাই অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে।

নিউজার্সির ভদ্রলোক মি. ভ্যান নস্ট্রান্ড : ‘ভদ্রমহোদয়গণ, আমি আপনাদের অপরিচিত। যে সম্মান আপনারা আমাকে দিলেন, সেটার অনুপযুক্ত আমি। বিশেষ করে আমি একটা সঙ্কোচ—’
আলাবামার মি. মর্গ্যান (বাধা দিয়ে) : আমিও পূর্ববর্তী প্রস্তাবটি পেশ করছি।

এ প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ায় বাক-বিতণ্ডা থেমে গেল। এবার শুরু হল কর্মকর্তা নির্বাচন। মি. গ্যাস্টন হলেন চেয়ারম্যান, মি. ব্লেক সেক্রেটারি; মেসার্স হলকুম, ডায়ার ও বলডুইনকে নিয়ে একটা কমিটি গঠিত হল। কমিটি আবার তাদের বাছাইয়ের কাজে সাহায্য করবার জন্যে মি. আর এম হাউল্যান্ডকে মনোনীত করলেন।

এবারে আধ-ঘণ্টার বিরতি। কিছুক্ষণ ফিসফাস। ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে আবার শুরু হল সভার কাজ। প্রার্থীরূপে কেন্টাকির মি. ফার্গুসেন, লুইসিয়ানার সুসিয়েন হারম্যান ও কলারাডোর ডরুমেসিকের নাম ঘোষণা করে কমিটি তাদের রিপোর্ট পেশ করলেন। বিবেচনার জন্যে গৃহীত হল এ-রিপোর্ট।

এবার উঠে দাঁড়ালেন মিসৌরির মি. রোজার্স। বললেন : মাননীয় সভাপতি, রিপোর্টটি এখন যথারীতি পরিষদের বিবেচ্য বলে, আমি একটি সংশোধনী প্রস্তাব আনতে চাই। আমি প্রস্তাব করছি, মি. হারম্যানের স্থলে সেন্ট লুই’র মি. সুসিয়ান হ্যারিসের নাম বসানো হোক। এ ভদ্রলোক সুস্থ সমর্থ—আর আমরা সকলেই তাকে সম্মানিত ব্যক্তি বলে মনে করি। কিন্তু তাই বলে কেউ যেন মনে করেন না, লুইসিয়ানার ভদ্রলোকের সম্মানিত চরিত্র সম্পর্কে কোনোরকম অশ্রদ্ধাজনক মন্তব্য করতে চাইছি আমি; সেটা আদৌ আমার উদ্দেশ্য নয়।

এখানে উপস্থিত আর কারো চাইতে তাঁকে আমি কম শ্রদ্ধা-ভক্তি করি না। কিন্তু একথা তো আমরা লক্ষ না-করে পারি না যে, গত একসপ্তাহে আমাদের অন্য যে কারো চাইতেও তার গায়ের গোশতই অনেক বেশি কমেছে। আমরা তো অন্ধ নই যে, কমিটির কাজের গাফলতি ধরতে পারব না। ভদ্রলোকের ইচ্ছে যত পবিত্রই হোক না কেন, কম পুষ্টির একজন লোককে আমাদের কল্যাণে নিয়োগ করে কমিটি হয় কর্তব্যে উপেক্ষা,
-না হয় বৃহত্তর কোনো অন্যায়’

সভাপতি : মিসৌরির ভদ্রলোক কি দয়া করে বসবেন? নিয়মমাফিক কোনো পদ্ধতি ছাড়া কমিটির কর্তব্যনিষ্ঠায় সন্দেহ প্রকাশ করতে দেওয়া চলতে পারে না। পরিষদ ভদ্রলোকের প্রস্তাব সম্পর্কে কী ব্যবস্থা করতে চান?

ভার্জিনিয়ার মি. হ্যালিডেঃ এই সঙ্গে আমি আরো প্রস্তাব করছি যে, মি. মেসিকের স্থলে ওরিগনের মি. হার্ভি ডেভিসের নাম বসানো হোক। উপস্থিত ভদ্রমহোদয়গণ বলতে পারেন যে, সীমান্ত অঞ্চলের কঠোর জীবন যাপন করে মি. ডেভিসের মাংসপিণ্ডগুলো শক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ভদ্রমহোদয়গণ, এটা কি শক্ত-নাম নিয়ে বাক-বিতণ্ডার সময়? এখন কি খুঁতখুঁত করার সময়? ছোটখাট ব্যাপারে মাথা ঘামানো কি এখন সাজে! না, ভদ্রমহোদয়গণ মেধা নয়, মাপকাঠি। এমনকি শিক্ষাও নয়—পুষ্টি, ওজন ও আকারই হচ্ছে আজকের সবচাইতে বড় মাপকাঠি। আমি দাবি করছি, আমার প্রস্তাব বিবেচনা করা হোক।

মি. মর্গ্যান (উত্তেজিত স্বরে) : মাননীয় সভাপতি, আমি প্রবলভাবে এ সংশোধনীর বিরোধিতা করছি। ওরিগনের ভদ্রলোক বৃদ্ধ, তাছাড়া হাড়গুলোই তার মোটা, মাংস বেশি নয়। ভার্জিনিয়ার ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করি, সুরুয়াই আমাদের দরকার, না চিবোবার মতো কিছু? ছায়া দেখিয়ে আমাদের ভোলাতে চান তিনি। এত দুঃখ-কষ্টের ভেতরে ওরিগনের হাড্ডি নিয়ে পরিহাস করতে চান তিনি? জিজ্ঞেস করি, চারপাশের উদ্বিগ্ন চোখ, বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে আর আশায় উত্তেজিত বুকের কথা মনে করেও এই দুর্ভিক্ষপীড়িত ঠগকে আমাদের কাঁধে চাপিয়ে দিতে চান তিনি? জানতে চাই, আমাদের দুর্ভাগ্য, অতীতের দুঃখ আর অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা মনে করেও ওরিগানের এই হাড্ডিসার, উজবুক আর হা-ঘরেকে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চান তিনি? না, কখনো না!’ (হাততালি)।

প্রস্তাবটি ভোটে দেওয়া হয় এবং উত্তেজিত বিতর্কের পর প্রত্যাখ্যাত হয়। প্রথম সংশোধনী গ্রহণ করে মি. হ্যারিসের নাম বসানো হল। এবার শুরু হল ব্যালট-ভোট। প্রথম পাঁচটি ব্যালটে কোনো সিদ্ধান্ত হয় না। ষষ্ঠ ব্যালটে মি. হ্যারিস নির্বাচিত হলেন। তিনি নিজে ছাড়া আর সকলেই তাঁর পক্ষে ভোট দেন। কে যেন প্রস্তাব করলেন যে, সকলে উল্লাসধ্বনি সহকারে নির্বাচনকে সমর্থন জানাবেন। এতেও কাজ হল না— মি. হ্যারিস নীরবই রইলেন।

এরপর মি. ব্যাভওয়ে প্রস্তাব করলেন, পরিষদ এবার বাকি প্রার্থীদের বিষয় বিবেচনা এবং প্রাতরাশের জন্যে কাউকে নির্বাচিত করুন। প্রস্তাবটা সঙ্গে সঙ্গেই বিবেচনার জন্যে গৃহীত হয়।

প্রথম ব্যালটে ভোটসংখ্যা সমান দাঁড়ায়। একদল একজন যুবককে নির্বাচিত করেন তার বয়সের কথা চিন্তা করে, অপরদল বপুর দিকে লক্ষ রেখে অন্য এক ব্যক্তির সপক্ষে মত দেন। সভাপতি শেষোক্ত প্রার্থী মি. মেসিকের পক্ষে তার ভোট দিলেন এ-সিদ্ধান্তে পরাজিত প্রার্থী মি, ফার্গুসনের বন্ধুদের ভেতর অসন্তুষ্টি দেখা দেয়। এমনকি কেউ কেউ আবার নতুন ব্যালটের কথা আলোচনাও শুরু করে দেন। এরই ভেতর একটা মুলতবি প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় সভা ভেঙে যায়।

রাতের খাবারের প্রস্তুতির দরুন সকলেরই মনোযোগ বিষন্তরে আকৃষ্ট হওয়ায় ফার্গুসন-সমর্থক দল তাদের অভিযোগ নিয়ে খুব বেশি আলোচনার সুযোগ পেলেন না। সুযোগ যখন পেলেন সৌভাগ্যবশত ঠিক তখুনি জানা গেল যে, মি, হ্যারিস তৈরি হয়ে গেছেন।

গাড়ির আসনগুলো উল্টে মোটামুটি টেবিলের কাজ চালাবার ব্যবস্থা করা হল আর তার চারপাশ ঘিরে বসলাম আমরা—সাতদিন পর প্রথম খাবারের আশায় উৎফুল্ল ক’জন মানুষ। মাত্র ক’টি ঘণ্টার ব্যবধান কী পরিবর্তনই-না আনতে পারে! একটু আগেও হতাশা বিষাদ, ক্ষুধা আর উদ্বেগ মূর্ত হয়েছিল সবারই চোখে-মুখে। আর এখন? সবার মুখেই এক অনির্বচনীয় আনন্দ ও উল্লাসের অভিব্যক্তি। ঘটনাবহুল আমার জীবনেও এর চাইতে সুখকর মুহূর্ত আর আসেনি। আমাদের কয়েদখানার উপরে আর চারপাশে তখনও ক্ষ্যাপা হাওয়া গর্জাচ্ছে, ঝেটিয়ে নিয়ে যাচেছ পেঁজা-তুলোর মতো বরফকে। কিন্তু তারা এখন শক্তিহীন। একটি প্রাণীও আর উদ্বিগ্ন নয় তাতে। হ্যারিসকে খুবই ভালো লেগেছিল আমার। রান্নাটা হয়তো আরেকটু ভালো করা যেত। তবু আজ অসঙ্কোচে বলতে পারি যে, আর কোনো মানুষই হ্যারিসের মতো আনন্দ দেয়নি আমাকে। অবশ্যি, মেসিকও ভালো ছিল, বিশেষ করে তার সুঘ্রাণটা মনে রাখবার মতো। কিন্তু পুষ্টি আর নরম আঁশের দিক থেকে হ্যারিসের সাথে তার তুলনা হয় না। নিন্দে না-করেও বলতে হয়, প্রাতরাশের জন্যে মরা মানুষের চাইতে মেসিক খুব বেশি ভালো কিছু ছিল না—রোগা-পাতলা, হাড্ডিসার। এমনটা যে, আপনি কল্পনা করতে পারবেন না।

‘তাহলে আপনারা সত্যি সত্যি–

‘দয়া করে বাধা দেবেন না। প্রাতরাশের পর রাতের খাবারের জন্যে আমরা ওয়াকার নামে ডেট্রয়েটের একজনকে নির্বাচিত করলাম। লোকটা খুব ভালো ছিল। পরে ওর স্ত্রীকেও সে-কথা লিখে জানিয়েছিলাম আমি। সত্যি প্রশংসা পাবার যোগ্য এই ওয়াকার। ওকে আমার মনে পড়বে। ছোটখাট হলেও ভালো ছিল লোকটা। পরদিন সকালে প্রাতরাশ হল আলাবামারার মর্গ্যানকে দিয়ে। অমন খাস লোকের স্বাদ পাইনি আর কখনো—সুন্দর, শিক্ষিত, মার্জিত। অনেকগুলো ভাষা জানত আর চমৎকার ভদ্রলোক। তাছাড়া, বেশ রসালও ছিল লোকটা। রাতে ছিল ওরিগনের পাদ্রিটার পালা। পয়লা নম্বরের জোচ্চোর ছিল লোকটা বুড়ো আর শক্ত। বিরক্ত হয়ে বললাম : ‘ভদ্রমহোদয়গণ আপনাদের যার যা খুশি করতে পারেন। নতুন করে নির্বাচন না হলে আমি কিন্তু আর হাত তুলছি না।’

ইলিওনিসের গ্রাহামও বলল : ‘ভদ্রমহোদয়গণ, আমারও সে-কথা। যদি দেখি সবদিক বিচার-বিবেচনা করে নির্বাচন করছেন আপনারা, তাহলে আবার সানন্দে আপনাদের দলে যোগ দেব। শিগগিরই দেখা গেল যে, ওরিগনের ডেভিসকে নিয়ে কম-বেশি সকলেই অখুশি হয়েছে। কাজেই হ্যারিসের সময় থেকে যে সদিচ্ছা বজায় ছিল সেটা টিকিয়ে রাখার জন্যে নতুন করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। আর এর ফলে জর্জিয়ার বেকারকে পছন্দ করা হয়। সে ছিল খাসা! হ্যা, এরপর পালা ছিল একে একে ডুলাইট, হকিন্স, ম্যাকলেয় (লোকটা খুব বেঁটে আর পাতলা বলে কেউ কেউ অখুশি হয়েছিল; তারপর পেড় জন শিথ, বেইলি (একটা পা এর কাঠের ছিল বলে মাংস কম ছিল; তাছাড়া ভালোই ছিল সে; তারপর একটি ইন্ডিয়ান ছেলে, অর্গান স্মিথ একজন তার বাকৃমিনাস্টার বলে এক ভদ্রলোক। শেষের লোকটা এক হাড্ডিসার হ-ঘরে, সঙ্গী হিসেবে যেমন অপাঙক্তেয়, খাবার টেবিলেও লোকটা ছিল ষাঁড়ের গোবর। কপাল ভালো যে, উদ্ধারকারী ট্রেন এসে পড়বার আগেই ওকে বেছে নিয়েছিলাম আমরা।’

‘তা হলে উদ্ধারকারী ট্রেন একটা এসেছিল শেষ পর্যন্ত?’

‘হ্যা, এসেছিল। ফুটফুটে রোদওয়ালা এক সকালে যখন আমরা সবে নির্বাচন শেষ করেছি, তখনই এসে পড়ে ট্রেনটা। সেদিন ঠিক হয়েছিল জন মারফির পালা। হলফ করে বলতে পারি, তখন আর তার চাইতে ভালো প্রার্থী ছিল না কেউ। অবশ্যি, উদ্ধারকারী ট্রেনে আমাদের সাথেই সে ফিরে আসে আর হ্যারিসের বিধবাকে বিয়ে করে—
‘হ্যারিসের’।

‘হ্যা, হ্যারিসের বউকে। সে তাকে বিয়ে করে। বেঁচে আছে বেশ সুখে-সম্পদে। উপন্যাসের মতো, মশাই—একেবারে প্রথম প্রেমের মতো। আমার নামবার জায়গাও এসে গেল। আপনার কাছ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে এবারে। সময় করে যদি দু-একদিনের জন্যেও বেড়াতে আসেন, খুবই খুশি হব। সত্যি বলতে কী, খুবই পছন্দ হয়েছে আপনাকে। প্রায় হ্যারিসের মতোই স্নেহ গজিয়ে গেছে আপনার ওপর। বিদায়! আপনার যাত্রা শুভ হোক।”

নেমে গেল। এর আগে কখনো এত বিপন্ন, অবসন্ন আর হতভম্ভ বোধ করিনি। লোকটা চলে যাওয়ায় অন্তর থেকে খুশি হলাম। ভদ্রতা আর অমায়িক ব্যবহার সত্ত্বেও যতবার সে ক্ষুধিত নেকড়ের মতো চোখ-দুটো তুলেছে আমার দিকে, ততবারই আতঙ্কে হাড়ে পর্যন্ত কাঁপন ধরে গেছে। এর ওপরও যখন শুনলাম, তার সর্বনেশে স্নেহদৃষ্টি পড়েছে আমার ওপর আর হ্যারিসের মতোই আমাকে তার ভালো লেগেছে, তখন তো বলতে গেলে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনই থেমে গেছে।

কতটা যে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি, বুঝিয়ে বলতে পারব না। একটি কথাতেও সন্দেহ হয়নি। আন্তরিকতায় গাঢ় এবং বর্ণনার প্রতিটি খুঁটিনাটিকে সত্যি বলে মেনে নিয়েছি–এতটা অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। কন্ডাক্টরকে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, কে লোকটা!

কন্ডাক্টর বললঃ এককালে কংগ্রেস সদস্য ছিলেন, বেশ নামকরা-ই। এক তুষারঝড়ে গাড়ির ভেতর আটকা পড়ে শুকিয়ে মরার দশা হয়। হিমে জমে এবং অনাহারে এত অসুস্থ হয়ে পড়েন যে, পরের দু-তিন মাস বদ্ধ পাগল হয়ে ছিলেন। এখন সেরে গেলেও কিছুটা মাথার গোলমাল রয়ে গেছে। সে ব্যাপারটার কথা উঠলে গাড়িসুদ্ধ জ্বলজ্যান্ত সব ক’টি মানুষকে খেয়ে সাবাড় করার আগে থামতে পারেন না। নেমে যেতে না-হলে বোধ হয় এতক্ষণে সাবাড়ই হয়ে যেত সকলে। আর নামগুলোও সব বলে যান গড়গড় করে। নিজেকে ছাড়া সকলকে খেয়ে শেষ করে বলেন : তারপর প্রাতরাশের জন্যে নির্বাচনের সময় এলে আমি যথাযোগ্যভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলাম। আর কোনোরকম আপত্তি না ওঠায় পদত্যাগ করলাম। তাই তো আজো বেঁচে রয়েছি।

তা হলে এক নির্দোষ পাগলের পাগলামি শুনছিলাম। সত্যিকারের নরখাদকের গল্প নয়! মনের শান্তিও ফিরে পেলাম।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments