Wednesday, April 24, 2024
Homeবাণী-কথাবাড়ি বিশাল (নক্ষত্রের রাত-১২) – হুমায়ূন আহমেদ

বাড়ি বিশাল (নক্ষত্রের রাত-১২) – হুমায়ূন আহমেদ

নক্ষত্রের রাত - হুমায়ূন আহমেদ

প্রফেসর ওয়ারডিংটনের বাড়ি বিশাল।

ছবিতে দেখা বাড়ির মতই কাঠের তৈরী, রেবেকা মুগ্ধ হয়ে গেল। ওয়ারডিংটন খুব উৎসাহের সঙ্গে রেবেকাকে সমস্ত বাড়ি দেখাতে লাগলেন–

বুঝলে রেবেকা, আমি এবং আমার স্ত্রী–এই দুজনে মিলেই এই বাড়ি তৈরি করতে শুরু করি। সামারে লেকের পাশে তাঁবু খাটিয়ে দুজন থাকতাম, সারা দিন কাজ করতাম। সম্বলের মধ্যে ছিল একটা ইলেকট্রিক করাত আর আমার ল্যাণ্ড রোভার গাড়ি। বন থেকে কাঠ কেটে আনতাম, কপিকল দিয়ে সেই কাঠ উপরে তুলে আস্তে আস্তে নামান হত। এক বার কী হল শোন, লুসি হঠাৎ একটা কাঠ ফেলে দিল আমার হাতে।

লুসি বিরক্ত স্বরে বলল, তুমি এমনভাবে বলছ, যেন ইচ্ছা করে ফেলে। দিয়েছি।

ওয়ারডিংটন হা-হা করে হাসতে লাগলেন।

আমরা এক সামারেই মোটামুটি থাকবার মত ঘর বানিয়ে ফেললাম। কিন্তু মজা কি জান, রেবেকা, ঘর তৈরী হলেও আমরা গোটা সামারটা বনেই কাটালাম। তাই না সুসি?

লুসি জবাব দিল না।

ওয়ারডিংটন বললেন, কেন বনে কাটালাম, সেই গল্প কি এই মেয়েটিকে বলে দেব লুসি?

কেন বেটারিকে গল্প বলে-বলে মাথা ধরিয়ে দিচ্ছ। ওকে নিজের মতো থাকতে দাও।

না, গল্পটা বলেই ফেলি। বুঝলে রেবেকা, আমরা বনে থাকতাম–কারণ সেই সময় আমাদের অনেক পাগলামি ছিল। আদম এবং ঈভের মতো থাকতে হচ্ছিল। হা-হা-হা। আশপাশে তখন এত বাড়ি-ঘর ছিল না, কাজেই আমাদের কোনো অসুবিধা হয় নি। তাই না লুসি? এ কি! এই বয়েসেও তুমি ফ্লাশ করছ, ব্যাপারটা কী?

ওয়ারডিংটন এবং তাঁর স্ত্রী ক্রিসমাস করছেন একা-একা। তাঁদের দুই ছেলে এবং তিন মেয়ের সবাই বাইরে। এক মেয়ে ফিলিপাইনে। ছেলেদের এক জন কোন এক যুদ্ধজাহাজে ভাসছে প্রশান্ত মহাসাগরে। রেবেকা থাকতে থাকতেই ছেলেমেয়েদের টেলিফোন আসতে শুরু করল।

লুসি বলল, আমাদের ক্রিসমাস ট্রী তোমার পছন্দ হয়েছে, রেবেকা?

খুব পছন্দ হয়েছে। এত সুন্দর করে সাজান।

ছেলেমেয়েরা যখন সঙ্গে ছিল তখন ওরা সাজাত, এখন আমাদেরকেই সাজাতে হয়। তখন বেশ খারাপ লাগে। সাজাতে-সাজাতে আমরা দুজনেই কিন্তু কাঁদি। কারণ এখানে অনেক ডেকোরেশন পিস আছে, যার সঙ্গে খুব কষ্টের কিছু গল্প আছে। যেমন ঐ যে রুপোর নেকলেসটা ঝুলছে, ওটা ছিল এলিজাবেথের। ও এগার বছর বয়সে পানিতে ড়ুবে মারা যায়।

লুসি চোখ মুছল।

ওয়ারডিংটন বললেন, আজকের দিনে ঐসব কথা মনে করে কোনো লাভ নেই। তার চেয়ে বরং গিফটগুলি খোল। প্রথমে রেবেকার গিফটগুলি তাকে দাও।

রেবেকা তার গিফট পেয়ে আকাশ থেকে পড়ল। অত্যন্ত দামী একটা ক্যামেরা দিয়েছে লুসি। ওয়ারডিংটন দিয়েছেন একটা মাখনের মতো নরম কম্বল। নিশ্চয়ই খুব দামী জিনিস। এ ছাড়াও গিফট ছিল। তাঁদের যে-মেয়ে কেনসাসে থাকে সে বাবার কাছে শুনেছে ক্রিসমাসের দিন এখানে একজন বিদেশী আসবে, কাজেই সে পাঠিয়েছে এ্যালবাম। সিয়াটলে তাদের হোট ছেলে থাকে, সে পাঠিয়েছে চামড়ার একটা ব্যাগ।

রেবেকার পর মার্টির গিটগুলো খোলা হল। মাটি হচ্ছে তাদের কুকুর। প্রায় অথর্ব। বয়সের কারণে এখন সে আর চোখে দেখে না। কানেও বোধহয় শুনতে পায় না। বিচিত্র সব উপহার পেয়েছে মার্টি। সেই উপহারের সবগুলি অন্ধ ও বধির মার্টির চারপাশে সাজিয়ে দেওয়া হল। ছেলেমেয়েদের সবাই উপহারের সঙ্গে সঙ্গে লিখে দিয়েছে–আমার হয়ে মাটিকে চুমু খাবে।

পাঁচ ছেলেমেয়ের জন্যে গুনে গুনে পাঁচ বার চুমু খেল লুসি, তারপর চোখ মুছতে লাগল।

ওয়ারডিংটন বললেন, মাটি আমার সন্তানের চেয়েও বেশি। বেচারার যা অবস্থা এখন, ওকে মেরে ফেলে জীবনের সব কষ্ট দূর করে দেওয়াই উচিত। এইটিই হচ্ছে। ওর জীবনের শেষ ক্রিসমাস।

ওকে মেরে ফেলবেন।

হ্যাঁ। দু-এক দিনের ভেতরই অপ্ৰিয় কাজটা করব। লুসি, তুমি মন শক্ত করেছ তো?

লুসি কিছু বলল না। মাটি লেজ নাড়াতে লাগল। পশুরা অনেক কিছু টের পায়।

ওয়ারডিংটন বললেন, এস রেবেকা, পোর্চে বসি।

রেবেকা পোর্টে গিয়ে বসল। পোর্চ অসম্ভব ঠাণ্ডা। একটা বড় পাত্রে আগুন জ্বালিয়ে মাঝখানে রাখা হয়েছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় আগুনের পাশে বসে থাকতে ভালোই লাগছে। ওয়ারডিংটন পাইপ ধরাতে-ধরাতে বললেন, তোমাকে এমন মনমরা লাগছে কেন?

রেবেকা কিছু বলল না।

দেশ থেকে কি কোনো খারাপ খবর পেয়েছ?

না।

তাহলে এত মন খারাপ করে আছ কেন?

রেবেকা ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার খুব শখ পি-এইচ. ডি করার।

সেই শখ পূরণে তো কোনো বাধা দেখছি না।

রেবেকা থেমে থেমে বলল, আমার ক দিন থেকেই মনে হচ্ছে আমাকে থাকতে দিতে কেউ রাজি হবে না।

কে রাজি হবে না?

আমার বাবা-মা। আমার স্বামী।

তোমার নিজের কেরিয়ার তুমি দেখবে না? কে কী বলল না-বলল, তাতে কী যায় আসে?

সব সময় আমরা নিজের ইচ্ছামতো কাজ করতে পারি না।

কেন পারি না, সেটা আমাকে বল।

রেবেকা চুপ করে রইল।

যুক্তিগুলি কী, আমাকে বল। যুক্তিগুলি শুনি।

ওদের যুক্তি আমার ভালো জানা নেই।

রেবেকা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। তার চোখ ভিজে উঠেছে। এই ভেজা চোখ সে কাউকে দেখাতে চায় না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments