Friday, April 19, 2024
Homeবাণী-কথাঅনুবাদ গল্পবিধবা ও তোতাপাখি - ভার্জিনিয়া উলফ

বিধবা ও তোতাপাখি – ভার্জিনিয়া উলফ

বিধবা ও তোতাপাখি - ভার্জিনিয়া উলফ

প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। ইয়র্কশায়ারে স্পিলবি নামে একটা গ্রাম ছিল। সেখানে থাকতেন এক বিধবা বৃদ্ধা, নাম মিসেস গেজ।

একদিন মিসেস গেজ তার কুটিরে বসে ছিলেন। যদিও তার এক পা খোঁড়া এবং চোখেও একটু কম দেখতেন, তবুও তিনি একজোড়া কাঠের জুতা মেরামত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছিলেন। কারণ এ সপ্তাহে চলার জন্য তার হাতে খুব বেশি টাকা-পয়সা ছিল না।

যখন তিনি কাঠের জুতায় প্রথম আঘাতটি করলেন, ঠিক তখনই দরজায় ডাকপিয়ন এলো। ডাকপিয়ন দরজা খুলে তার কোলে একটা চিঠি ছুড়ে দিল। চিঠিটার গায়ে ঠিকানা লেখা ছিল ‘মেসার্স স্ট্যাগ অ্যান্ড বিটল, ৬৭ নম্বর সড়ক, লুইস, সাসেক্স’। মিসেস গেজ চিঠিটা খুলে পড়লেন- ‘ম্যাডাম গেজ, আপনার ভাই মিস্টার জোসেফ ব্র্যান্ডের মৃত্যুর খবর আপনাকে জানাতে পেরে আমরা সম্মানিত।’

মিসেস গেজ বললেন, ‘হায় খোদা! বড় ভাই জোসেফও শেষ পর্যন্ত চলে গেল!’

চিঠিতে আরো লেখা ছিল, ‘তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি আপনার জন্য রেখে গেছেন। এর মধ্যে আছে আপনার জন্য একটা থাকার ঘর, আস্তাবল, শসার মাচান, কাপড় ইস্ত্রি করার যন্ত্র, ঠেলাগাড়ি ইত্যাদি। এগুলো আছে লুইসের কাছে রডমেল গ্রামে। তিনি আপনার জন্য তার সমস্ত সঞ্চয় তিন হাজার পাউন্ড স্টার্লিং-ও রেখে গেছেন।’

মিসেস গেজ তার ভাইয়ের কৃপণ স্বভাবের সাথে ছোটবেলা থেকেই ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন। পাল্টা শুভেচ্ছা কার্ড বা প্রতিউত্তর দেওয়ার জন্য এক পয়সা দিয়ে স্ট্যাম্প কিনতে হবে, এটা হয়তো তাকে বিরক্ত করার জন্য যথেষ্ট!

মিসেস গেজ আনন্দের চোটে প্রায় আগুনেই পড়তে যাচ্ছিলেন। তিনি তার ভাইকে অনেক বছর ধরে দেখেননি, তবে তিনি প্রতি বছরই তাকে বড়দিনের শুভেচ্ছা কার্ড পাঠাতেন। যদিও সেগুলোর জন্য তার ভাই কোনো প্রাপ্তিস্বীকার করেনি বা পাল্টা তাকে কোনো শুভেচ্ছাও জানায়নি। মিসেস গেজ তার ভাইয়ের কৃপণ স্বভাবের সাথে ছোটবেলা থেকেই ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন। পাল্টা শুভেচ্ছা কার্ড বা প্রতিউত্তর দেওয়ার জন্য এক পয়সা দিয়ে স্ট্যাম্প কিনতে হবে, এটা হয়তো তাকে বিরক্ত করার জন্য যথেষ্ট!

কিন্তু এখন এসব কথা ভেবে আর কাজ কী! বরং তিন হাজার পাউন্ড স্টার্লিং, একটা বাড়ি- এসব নিয়ে মিসেস গেজ এখন বাকি জীবন বিলাসিতায় কাটিয়ে দিতে পারবেন।

মিসেস গেজ ঠিক করলেন যে তাকে একবার রডমেল গ্রামে যেতে হবে। গ্রামের পাদ্রী রেভারেন্ড স্যামুয়েল ট্যালবয় তার যাতায়াতের ভাড়া পরিশোধের জন্য দুই পাউন্ড ধার দিলেন। পরদিন তার যাত্রার সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে গেল। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার অনুপস্থিতিতে তার কুকুর শ্যাগের যত্ন নেওয়া। মিসেস গেজ গরিব হলেও তিনি প্রাণীদের প্রতি খুবই দায়িত্বশীল ছিলেন এবং প্রায়ই কুকুরটিকে হাড় খাওয়াতে গিয়ে তার নিজের পাতেই খাবার কম পড়ে যেত।

মঙ্গলবার গভীর রাতে তিনি লুইসে পৌঁছান। আপনাদের জানিয়ে রাখি যে সেই দিনগুলোতে, সাউথইজ গ্রামে নদীর উপর কোনো সেতু ছিল না, কিংবা নিউহ্যাভেনের রাস্তা তখনো তৈরি হয়নি। রডমেলে যাওয়ার জন্য একটা সরু খাত দিয়ে হেঁটে ওউস নদী পার হতে হতো। এই পথের চিহ্ন এখনও পাওয়া যায়, তবে সেখানে শুধু ভাটার সময়, যখন নদীর তলের পাথরগুলো পানির ওপর থেকে দেখা যায়, তখনই পার হওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে।

পাখিটার মেজাজ বেশ চড়া। সে এককালে এক নাবিকের কাছে ছিল এবং তার কাছেই আজেবাজে ভাষা শিখে ফেলে।

মিস্টার স্টেসি একজন কৃষক। তিনি তার কার্টে (চার চাকার এক ধরনের ঘোড়ায় টানা মালগাড়ি) করে রডমেল যাচ্ছিলেন। পরোপকারী মিস্টার স্টেসি মিসেস গেজকে তার সাথে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। নভেম্বরের সেই রাতে ৯টার দিকে তারা রডমেলে পৌঁছান এবং মিস্টার স্টেসি গ্রামের শেষ মাথায় মিসেস গেজকে সেই বাড়িটি দেখিয়ে দিলেন যেটি তার ভাই তার জন্য রেখে গিয়েছিল।

মিসেস গেজ ওই বাড়ির দরজায় টোকা দিলেন। কোনো সাড়া মিলল না। তিনি আবার টোকা দিলেন। এবার খুব অদ্ভুত এবং উচ্চস্বরে কেউ চিৎকার করে উঠল, ‘বাড়িতে কেউ নেই।’

এমন তীব্র আওয়াজে মিসেস গেজ এতটাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে কারও পায়ের আওয়াজ না শুনলে তিনি হয়তো পালিয়েই যেতেন। যাইহোক দরজা খুললেন গ্রামের এক বুড়ি, নাম মিসেস ফোর্ড।

মিসেস গেজ বললেন, কে যেন চিৎকার করছিল ‘বাড়িতে কেউ নেই?’

একটি বড় ধূসর তোতাপাখির দিকে ইশারা করে মিসেস ফোর্ড খুব বিরক্তির ভাব নিয়ে বললেন, ‘ওই হাড়-জ্বালানো পাখিটা। সে প্রায়ই চিৎকার করে আমার দম বন্ধ করে ফেলে। ওইখানে তার বসার লাঠিটার ওপর সে সারাদিন মূর্তির মতো ঠায় বসে থাকে আর চিৎকার করে বলে ‘বাড়িতে কেউ নেই’। যদি কখনো তার বসার লাঠিটার কাছে যান, তবেই তাকে দেখতে পাবেন।’

মিসেস গেজ যেন মনের চোখে দেখতে পেলেন, পাখিটা এককালে খুব সুদর্শন ছিল। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো অবহেলায় পাখিটার পালকগুলো কেমন যেন হয়ে গেছে। তিনি বললেন, ‘সম্ভবত পাখিটার মনে সুখ নেই অথবা সে হয়তো ক্ষুধার্ত।’

কিন্তু মিসেস ফোর্ড জানালেন, পাখিটার মেজাজ বেশ চড়া। সে এককালে এক নাবিকের কাছে ছিল এবং তার কাছেই আজেবাজে ভাষা শিখে ফেলে। যাইহোক, মিস্টার জোসেফ পাখিটাকে খুবই পছন্দ করতেন এবং তাকে জেমস বলে ডাকতেন। তিনি নাকি পাখিটার সাথে এমনভাবে কথা বলতেন যেন সেটা কোনো একটা যুক্তিশীল মানুষ।

মিসেস ফোর্ড শীঘ্রই চলে গেলেন। মিসেস গেজ তার বাক্সে থাকা কিছু চিনি এনে তোতাপাখিটাকে দিলেন। তিনি খুব সদয় সুরে বললেন যে তিনি পাখিটার কোনো ক্ষতি করতে চাইছেন না; এ-ও বললেন যে তিনি পাখিটার পুরোনো মালিকের বোন এবং এই বাড়িটার দখল নিতে এসেছেন। তিনি বাড়িটা ঘুরে দেখবেন। যাইহোক, পাখিটা ততটাই খুশি থাকল যতটা একটা পাখির পক্ষে খুশি থাকা সম্ভব।

ওই পাখিটার ভাষা খুবই নোংরা। ওটা কোনো কাজেরই না। আমার মনে হচ্ছে আপনি অকারণেই এখানে আসলেন। বাড়িটাও জরাজীর্ণ এবং অবশ্যই আমাদের খরচও যথেষ্ট।

মিসেস গেজ একটা বাতি নিয়ে বাড়িটার চারপাশে ঘুরে দেখেছিলেন। তিনি বুঝতে চাইছিলেন যে তার ভাই তার জন্য কী ধরনের সম্পত্তি রেখে গেছে। কিন্তু এটা তার জন্য খুবই হতাশাজনক মনে হতে লাগল। বাড়িটার সমস্ত কার্পেটে গর্ত আর চেয়ারগুলোর তলা খসে পড়েছিল। চুলার ওপরের তাক দিয়ে একটা ইঁদুর দৌড়ে গেল। রান্নাঘরের মেঝেতে বড় বড় ব্যাঙের ছাতা (ছত্রাক জাতীয় উদ্ভদ) বেড়ে উঠেছিল। দুই পয়সা দাম পাওয়ার মতো কোনো আসবাবপত্রের কাঠও ছিল না সেখানে। শুধু এই ভেবে মিসেস গেজ নিজেকে উৎফুল্ল রাখছিলেন যে লুইস ব্যাঙ্কে অন্তত তিন হাজার পাউন্ড স্টার্লিং জমা আছে তার জন্য।

পরদিন মিসেস গেজ আইনজীবী স্ট্যাগ এবং বিটলের কাছ থেকে তার জন্য ভাইয়ের রেখে যাওয়া অর্থ দাবি করতে লুইসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর তারপর তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরতে চান। মিস্টার স্টেসি ওইদিন কয়েকটা শূকর নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন। আবারও তিনি মিসেস গেজকে তার সাথে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। পথে স্টেসি তাকে কয়েকজন যুবকের জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়ানক সব ঘটনার গল্প শোনালেন। ওই যুবকেরা ভরা জোয়ারের সময় নদী পার হতে গিয়ে ডুবে গিয়েছিল।

বেচারি মিসেস গেজ, তিনি সরাসরি মিস্টার স্ট্যাগের অফিসে দেখা করতে গেলেন। আর এখানেও তাকে হতাশই হতে হলো। মিস্টার স্ট্যাগ খুব গম্ভীর ও মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘দয়া করে বসুন ম্যাডাম। বাস্তবতা হলো আপনাকে কিছু অপ্রীতিকর সংবাদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যেহেতু আমিই আপনাকে চিঠিটা লিখেছি, পরে আমি নিজেই খুব যত্নের সাথে মিস্টার জোসেফ ব্র্যান্ডের কাগজপত্র দেখেছি। কিন্তু আফসোসের কথা যে তিন হাজার পাউন্ডের কোনো চিহ্নই আমি খুঁজে পাইনি। আমার সঙ্গী মিস্টার বিটল নিজে রডমেলে গিয়েছিলেন এবং এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেছিলেন। তিনিও কিছুই খুঁজে পাননি- সোনা, রুপা বা কোনো মূল্যবান জিনিসপত্রই সেখানে নেই। শুধু একটা ধূসর রঙের তোতাপাখি আছে, ওটাকেই বরং আপনি বিক্রি করে দিন।’

বেঞ্জামিন বিটল বলেছেন, ‘ওই পাখিটার ভাষা খুবই নোংরা। ওটা কোনো কাজেরই না। আমার মনে হচ্ছে আপনি অকারণেই এখানে আসলেন। বাড়িটাও জরাজীর্ণ এবং অবশ্যই আমাদের খরচও যথেষ্ট।’ এটুকু বলেই মিস্টার স্ট্যাগ থামলেন। মিসেস গেজও ভালো করেই বুঝলেন যে তাকে এবার চলে যেতে হবে- এটাই মিস্টার স্ট্যাগের ইচ্ছা।

.

মিসেস গেজ হতাশায় যেন প্রায় পাগল হয়ে গেলেন। তিনি রেভারেন্ড স্যামুয়েল ট্যালবয়ের কাছ থেকে দুই পাউন্ড ধার করে এখানে এসেছিলেন। আর এখন তাকে একেবারে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।

হয়তো তাকে ভাড়া পরিশোধ করার জন্য তোতা জেমসকেই বিক্রি করতে হবে। বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, কিন্তু তারপরও মিস্টার স্ট্যাগ তাকে থাকার জন্য বললেন না। মিসেস গেজ যা করেছেন, তার জন্য ভীষণ দুঃখ হলেও এ জ্বালা মেটাতে তার নিজেকেই নিজের পাশে থাকতে হবে। তাই প্রবল বৃষ্টি সত্ত্বেও তিনি তৃণভূমি পার হয়ে রডমেলের দিকে ফিরে যেতে শুরু করেন।

পাঠকদের আগেই বলেছিলাম যে মিসেস গেজের ডান পা খোঁড়া ছিল। সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও তার হাঁটার গতি ছিল খুবই ধীর। তার ওপর এখন তার হতাশা এবং বৃষ্টির কারণে নদী তীরের কাদা তার হাঁটার গতিকে আরও ধীর করে তুলেছিল। তিনি যতই নদীর দিকে পথ পাড়ি দিচ্ছিলেন, দিনটা ততই অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকার হয়ে আসছিল।

আপনি হয়তো হাঁটতে হাঁটতে তার বিড়বিড় করে বলা এসব কথাও শুনতে পাবেন। তিনি তার ধূর্ত ভাই জোসেফের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিলেন, যে তাকে এই সমস্ত সমস্যায় ফেলেছিল। মিসেস গেজ বলছিলেন, ‘আমাকে বিপদে ফেলতেই সে এমন করেছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখনও সে নিষ্ঠুর ছোট ছেলে ছিল। সে বেচারা নিরীহ পোকামাকড়গুলোকে বিরক্ত করতে পছন্দ করতো। আমি তাকে আমার চোখের সামনে একটা কাচি দিয়ে একটি শুঁয়োপোকার পশম কাটতে দেখেছি। সে তখনও এমন কৃপণ ছিল। সে তার পকেটের টাকা একটা গাছে লুকিয়ে রাখত। যদি কেউ তাকে চায়ের জন্য এক টুকরো ঠান্ডা কেক দিত, তবে সে চিনিটি তার রাতের খাবারের জন্য রেখে দিত। কোনো সন্দেহ নেই যে সে এই মুহূর্তে নরকের আগুনেই জ্বলছে। কিন্তু তাতে আমার লাভ কী?’

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল। একটি বিশাল আলোর রেখা আকাশের দিকে দেখা গেল, একটা বড় টর্চের আলোর মতো। সেই আলো ঘাসের প্রতিটি ডগাকে আলোকিত করে তুলল।

সত্যিই এসব ভেবে খুব কমই সান্ত্বনা পাওয়া যাচ্ছিল। এমন সময় বেখেয়ালে তিনি একটি বড় গরুকে ধাক্কা দিয়ে বসেন এবং এর ফলে এক পাক ঘুরে তিনি কাদার উপর পড়ে যান। তিনি অনেক কষ্টে নিজেকে টেনে তুলতে পারলেন এবং কোনোরকমে আবার হাঁটতে শুরু করলেন। তার মনে হচ্ছিল যেন তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটছেন। এখন অন্ধকার হয়ে এসেছে এবং তিনি তার নাকের সামনে নিজের হাত ধরলেও আর দেখতে পারছিলেন না। হঠাৎ তার মনে পড়ল নদীর অগভীর সরু খাতটি সম্পর্কে কৃষক স্টেসির বলা কথাগুলো। তিনি বললেন, ‘হে খোদা, তাহলে কি আমি আমার পথ খুঁজে পাব? যদি জোয়ার আসে, আর আমি গভীর জলে পা রাখি, তাহলে তো নিমিষেই সমুদ্রের দিকে ভেসে যাব! এখানে ডুবে যাওয়া অনেক দম্পতি; ঘোড়া, গাড়ি, গবাদি পশুর পাল এবং খড়ের স্তুপ- কতকিছুর না ভেসে গেছে।’

আসলেই অন্ধকার আর কাদার মধ্যে একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা হলো মিসেস গেজের। তিনি নদীটাকে খুব কমই দেখতে পাচ্ছিলেন, সুতরাং তিনি সেই সরু খাতে পৌঁছেছেন কিনা তা তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না। কোথাও কোনো আলো দেখা যাচ্ছিল না। কারণ, আপনি হয়তো জানেন, আশেহাম হাউস যেখানে এখন মিস্টার লিওনার্ড উলফ থাকেন, এটার কাছাকাছি নদীর ওই ধারে কোনো কুঁড়েঘর বা বাড়ি নেই। মনে হচ্ছিল সকালের জন্য বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। কিন্তু মিসেস গেজের যা বয়স এবং সেইসাথে আছে রিউমেটিকসের ব্যথা, হয়তো তিনি ঠান্ডায় মারাই যেতে পারেন।

অন্যদিকে, যদি তিনি নদী পার হওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে তার ডুবে যাওয়াও প্রায় নিশ্চিত। তার অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে তিনি হয়তো সানন্দে মাঠের একটি গরুর সাথে তার জায়গা পরিবর্তন করতেন। সাসেক্সের পুরো প্রদেশেই বোধহয় আর কোনো এমন হতভাগা বুড়িকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে কিনা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ভেবে পাচ্ছিল না বসতে হবে নাকি সাঁতার কাটতে হবে, নাকি ভেজা ঘাসে তাকে গড়িয়ে যেতে হবে!

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল। একটি বিশাল আলোর রেখা আকাশের দিকে দেখা গেল, একটা বড় টর্চের আলোর মতো। সেই আলো ঘাসের প্রতিটি ডগাকে আলোকিত করে তুলল এবং মিসেস গেজ বিশ গজ দূরে নদীর সেই সরু খাতটা দেখতে পেলেন। ওই সময় নদীতে ভাটা চলছিল এবং পারাপারের জন্য এখনই ঠিক সময় বলে মনে হলো যদি না তার আগেই আলোটা নিভে যায়। ‘এটা অবশ্যই একটি ধূমকেতু বা এমন কিছু বিস্ময়কর দানবীয় জিনিস হবে!’ মিসেস গেজ আপন মনেই বললেন। তিনি তার সামনে আলোয় ঝলমল করতে থাকা রডমেল গ্রামটাকে দেখতে পাচ্ছিলেন।

‘আমাদের করুণা করো, আমাদের রক্ষা করো খোদা।’ চিৎকার করে বললেন মিসেস গেজ। ‘একটা বাড়িতে আগুন লেগেছে, সেজন্য খোদাকে ধন্যবাদ।’ মিসেস গেজ ভেবেছিলেন যে আগুনে একটা বাড়ি পুড়তে অন্তত কয়েক মিনিট সময় তো লাগবেই এবং এই সময়ের মধ্যে তিনি গ্রামে যাওয়ার পথ ঠিকঠাক খুঁজে নেবেন। মিসেস গেজ রোমান রাস্তা ধরে চলতে চলতে বলছিলেন, ‘এটা একটা খারাপ বাতাস, যা কারও ভালো করে না।’ নিশ্চিতভাবে তিনি পথের প্রতিটি ইঞ্চি দেখতে পারছিলেন এবং যখন তিনি গ্রামের রাস্তায় প্রায় এসে পড়লেন, তখন এটা তার মনে প্রথমবারের মতো ধাক্কা দিল, ‘সম্ভবত এটা আমার নিজেরই বাড়ি যা আমার চোখের সামনেই জ্বলছে!’

হঠাৎ জানালায় সামান্য টোকা দেওয়ার মতো শব্দ হলো। পর পর তিনবার কেউ টোকা মারল। মিসেস গেজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গেলেন।

তার ধারণা একেবারে ঠিক ছিল। রাতের পোশাক পরা একটি ছোট ছেলে তার কাছে এসে চিৎকার করে বলল, ‘এসো, দেখে যাও। বুড়ো জোসেফ ব্র্যান্ডের বাড়িটা পুড়ে গেছে!’ সমস্ত গ্রামবাসী বাড়ির চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা মঙ্কস হাউসের রান্নাঘরের কুয়া থেকে বালতি ভরে পানি তুলে এনে আগুনের ওপর ছুড়ে মারছিল। কিন্তু আগুনটা বেশ ভালোভাবেই ধরেছিল এবং মিসেস গেজের আসার সাথে সাথেই ছাদটা পড়ে গেল।

‘কেউ কি তোতাটাকে বাঁচিয়েছে?’ মিসেস গেজ আর্তস্বরে বললেন। পাদ্রী রেভারেন্ড জেমস হকসফোর্ড বললেন, ‘এজন্য খুশি থাকুন ম্যাডাম যে আপনি নিজে বেঁচেবর্তে আছেন। বোবা প্রাণীদের জন্য চিন্তা করবেন না। আমার মনে হয় তোতাপাখিটি তার বসার লাঠিটায় করুণভাবে দম আটকে মরে গেছে।’

কিন্তু মিসেস গেজ বিষয়টা নিজে দেখতে চাইছিলেন। গ্রামের লোকেরা তাকে নানাভাবে আটকাতে চাইছিল। তারা মন্তব্য করছিল যে কেউ পাগল না হলে একটা পাখির জন্য জীবন বিপন্ন করে!

মিসেস ফোর্ড বললেন, ‘বেচারি বুড়ি! তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি হারিয়েছেন। শুধু একটা পুরোনো কাঠের বাক্স বাঁচিয়েছেন, যেটায় তার রাতে থাকার জিনিসপত্র রয়েছে। হয়তো তার জায়গায় থাকলে আমরাও পাগল হয়ে যেতাম!’ এই বলে মিসেস ফোর্ড মিসেস গেজের হাত ধরে তাকে তার নিজের কুঁড়েঘরে নিয়ে গেলেন, যেখানে তাকে রাতে ঘুমাতে হবে। এখন আগুন নিভে গেছে, তাই যে যার ঘরে শুতে গেল।

কিন্তু বেচারি মিসেস গেজ কিছুতেই ঘুমাতে পারলেন না। তিনি তার করুণ অবস্থার কথা ভেবে হাত-পা ছুঁড়ছিলেন। হতাশ হয়ে তিনি ভাবছিলেন, কীভাবে তিনি ইয়র্কশায়ারে ফিরে যাবেন এবং রেভারেন্ড স্যামুয়েল ট্যালবয়কে ধারের অর্থ পরিশোধ করবেন। সেইসাথে তিনি অসহায় তোতাপাখিটার ভাগ্যের কথা ভেবে আরও বেশি দুঃখ পাচ্ছিলেন। তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই পাখিটাকে পছন্দ করে ফেলেছিলেন। তিনি ভাবলেন, বৃদ্ধ জোসেফ ব্র্যান্ডের কোনো মানুষ বা প্রাণীর প্রতি দয়ামায়া ছিল না; তার মৃত্যুর জন্য এত গভীর শোক যে পাখিটার, তার নিশ্চয়ই একটা কোমল হৃদয় আছে। এটা একটা নিরীহ পাখির জন্য ভয়ংকর মৃত্যু! যদি তিনি সময়মতো এখানে থাকতেন, তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও তাকে বাঁচাতে পারতেন।

মিসেস গেজ যখন বিছানায় শুয়ে এসব ভাবছিলেন, তখন হঠাৎ জানালায় সামান্য টোকা দেওয়ার মতো শব্দ হলো। পর পর তিনবার কেউ টোকা মারল। মিসেস গেজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গেলেন।

.

মিসেস গেজ যখন বিছানায় শুয়ে এসব ভাবছিলেন, তখন হঠাৎ জানালায় সামান্য টোকা দেওয়ার মতো শব্দ হলো। পরপর তিনবার কেউ টোকা মারল। মিসেস গেজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গেলেন। অবাক হয়ে দেখলেন, জানালার ধারে বসে ছিল একটা মস্ত বড় তোতাপাখি।

বৃষ্টি থেমে গেছে এবং এটা একটা সুন্দর চাঁদনী রাত ছিল। তিনি প্রথমে খুব শঙ্কিত হয়েছিলেন, কিন্তু শীঘ্রই ধূসর তোতা জেমসকে চিনতে পারলেন। পাখিটা যে পালিয়ে বাঁচতে পেরেছে- তা দেখে মিসেস গেজ সত্যিই আনন্দিত হলেন। তিনি জানালা খুললেন এবং পাখিটার মাথায় কয়েকবার টোকা দিয়ে তাকে ভেতরে আসতে বললেন।

তোতাপাখি আলতো করে তার মাথা এদিক-ওদিক নাড়িয়ে যেন এর উত্তর দিল। তারপর উড়ে মাটিতে বসল, কয়েক কদম সামনে গেল। তারপর আবার পেছনে ফিরে তাকাল যেন দেখতে পারে মিসেস গেজ পিছু পিছু আসছিলেন কিনা। তারপর পাখিটা গেল জানালার ধারে, যেখানে মিসেস গেজ একটু আগে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

হঠাৎ করেই সে খুবই উত্তেজিত হয়ে ডানা ঝাপটাতে লাগল এবং বারবার তার ঠোঁট দিয়ে মেঝেতে টোকা দিতে লাগল। এসময় সে খুব চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘বাড়িতে কেউ নেই! বাড়িতে কেউ নেই!’

মিসেস গেজ নিজেকে বললেন, ‘প্রাণীটার কাজের মধ্যে আমাদের জানার চেয়েও বেশি কোনো অর্থ আছে। খুব ভালো, জেমস।’ তিনি উচ্চস্বরে বললেন। মিসেস গেজ পাখিটার সাথে এমনভাবে কথা বললেল যেন সে একজন মানুষ। ‘আমি তোমার কথা মেনে নেব। আমার কাপড়টা ঠিক করা পর্যন্ত একটু অপেক্ষা কর।’ এই বলে তিনি একটা বড় অ্যাপ্রোনের ওপর পিন লাগালেন। এরপর যতটা সম্ভব নিঃশব্দে নিচে নামলেন এবং মিসেস ফোর্ডকে না জাগিয়ে একাই বেরিয়ে গেলেন।

বোঝাই যাচ্ছিল যে তোতা জেমস বেশ সন্তুষ্ট ছিল। সে কয়েক গজ সামনে এগিয়ে পুড়ে যাওয়া বাড়িটার দিকে চলে গেল। মিসেস গেজও তাকে যত দ্রুত সম্ভব অনুসরণ করছিলেন। তোতাপাখিটি এমনভাবে যাচ্ছিল যেন সে তার পথটি পুরোপুরি জানে। সে গেল বাড়ির পেছনের দিকে, যেখানে রান্নাঘরটা ছিল। সেখানে ইটের মেঝে ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, যেটা তখনও আগুন নেভানোর জন্য ছুঁড়ে মারা পানির কারণে ভেজা ছিল। মিসেস গেজ বিস্ময়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন যখন জেমস এদিক-ওদিক ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে ইটগুলো পরীক্ষা করছিল। খুব অদ্ভুত একটা দৃশ্য। মিসেস গেজের যদি পশুদের সাথে থাকার অভ্যাস না থাকত, তাহলে সম্ভবত এতক্ষণে তিনি মাথা গরম করে বাড়ি ফিরে যেতেন।

কিন্তু আরও অদ্ভুত ব্যাপার তখনও বাকি। এতক্ষণ তোতাপাখিটা একটা কথাও বলেনি। হঠাৎ করেই সে খুবই উত্তেজিত হয়ে ডানা ঝাপটাতে লাগল এবং বারবার তার ঠোঁট দিয়ে মেঝেতে টোকা দিতে লাগল। এসময় সে খুব চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘বাড়িতে কেউ নেই! বাড়িতে কেউ নেই!’ মিসেস গেজ ভয় পাচ্ছিলেন যে পুরো গ্রামটাই না জেগে যায়!

‘এত উত্তেজিত হয়ো না জেমস, তুমি তো নিজেরই ক্ষতি করে বসবে।’ রেগে বললেন মিসেস গেজ। কিন্তু পাখিটা আগের চেয়ে আরও বেশি হিংস্রভাবে ইটের উপর তার আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগল। ‘এর মানে কী হতে পারে?’ রান্নাঘরের মেঝেতে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে বললেন মিসেস গেজ। চাঁদের আলো যথেষ্ট উজ্জ্বল ছিল। সেই আলোয় তিনি বুঝতে পারছিলেন যে বিছিয়ে রাখা ইটগুলোর মধ্যে কয়েকটা ইট ছিল অন্যগুলোর তুলনায় অসমান। মনে হচ্ছিল যেন সেগুলো তুলে নেওয়া হয়েছিল। তিনি একটি বড় সেফটিপিন দিয়ে তার অ্যাপ্রোনটি বেঁধে রেখেছিলেন। এবার তিনি ইটের মধ্যে সেই পিনটি দিয়ে চাপ দিয়ে বুঝতে পারলেন সেগুলো একেবারেই আলগাভাবে রাখা হয়েছে।

খুব শীঘ্রই তিনি সেখান থেকে একটা ইট নিজের হাতে তুলে নিলেন। মিসেস গেজ একটা ইট তুলতে না তুলতেই তোতাপাখিটা পাশের আরেকটি ইটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তার ঠোঁট দিয়ে সেটাকে টোকা দিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘বাড়িতে কেউ নেই!’ এর মানে মিসেস গেজ বুঝতে পারলেন, এই ইটটাও সরাতে হবে। তাই তারা চাঁদের আলোয় ইটগুলো তুলতে থাকল, যতক্ষণ না তারা ছয় ফুট বাই সাড়ে চার ফুটের মতো একটা জায়গা খালি করে ফেলল। এবার তোতার মনে হলো যথেষ্ট হয়েছে, কিন্তু এবার কী করতে হবে?

মিসেস গেজ একটু জিরিয়ে নিলেন এবং ঠিক করলেন তোতা জেমস তার আচরণ দিয়ে তাকে যেভাবে পরিচালনা করবে, সেভাবেই তিনি চলবেন। অবশ্য বেশিক্ষণ জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো না। কয়েক মিনিটের জন্য পাখিটা বালুময় ভূমিতে আঁচড় দেওয়ার পর, যেমনটা আপনি হয়তো দেখে থাকবেন মুরগিকে তার নখ দিয়ে বালুতে আঁচড় দিতে, সে গোলাকার হলুদ পাথরের পিণ্ডের মতো কিছু একটা খুঁজে বের করলো। তার উত্তেজনা এতটাই বেড়ে গেল যে মিসেস গেজ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেলেন। তিনি বিস্ময়ের সাথে দেখলেন যে তারা যে জায়গাটা খুঁড়ে বের করেছিল, তা এই গোলাকার হলুদ পাথরের লম্বা রোল দিয়ে ভরা। সেগুলো এত সুন্দরভাবে একসাথে রাখা হয়েছে যে তাদের সরানোটা বেশ কঠিন কাজই ছিল।

যে মুহূর্তে মিসেস গেজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, জেমস তোতাপাখিটা চিৎকার করে উঠল, ‘বাড়িতে কেউ নেই! বাড়িতে কেউ নেই!’ সেই সঙ্গে তার দাঁড়ানোর লাঠিটা থেকে পড়ে মরে গেল।

কিন্তু সেখানে কী থাকতে পারে? আর কী উদ্দেশ্যেই বা তাদের এখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর তারা ততক্ষণ পাবে না যতক্ষণ তারা উপরের পুরো স্তরটি সরিয়ে ফেলল। এরপর তারা এর নিচে পড়ে থাকা অয়েলক্লথের টুকরাটিও সরিয়ে ফেলল। এবার তারা চোখের সামনে যা দেখল, তা যেন বিশ্বাস করাই কঠিন! সারিবদ্ধ ও সুন্দরভাবে পালিশ করা হাজার হাজার মুদ্রা সেখানে রাখা। সেগুলো উজ্জ্বল চাঁদের আলোতে চকচক করে উঠল!

তাহলে এই ছিল কৃপণ জোসেফের গুপ্তধন লুকিয়ে রাখার জায়গা! লোকটা এটাও নিশ্চিত করেছিলেন যে এত সহজে যেন কেউ এটা খুঁজে না পায়। প্রথমত, তিনি তার ধন-সম্পদ যেখানে লুকিয়ে রেখেছিলেন, সেখানে একটি রান্নাঘর তৈরি করেছিলেন, তা-ও এমনভাবে যেন আগুন সেগুলোকে ধ্বংস করতে না পারে এবং গুপ্তধনের অস্তিত্ব কেউ অনুমান করতে না পারে। দ্বিতীয়ত, তিনি মুদ্রাগুলোর উপরের স্তরে কিছু আঠালো পদার্থ দিয়ে প্রলেপ করে দিয়েছিলেন, তারপর সেগুলোকে মাটিতে গড়িয়ে দিয়েছিলেন। এতে করে যদি কেউ ঘটনাক্রমে জায়গাটা আবিষ্কার করেও ফেলত, দেখত যে সেখানে নুড়ি পাথর ছাড়া আর কিছুই নেই। সুতরাং, শুধু আগুন লাগার মতো একটা কাকতালীয় ঘটনা এবং তোতাপাখির বিচক্ষণতার কারণেই জোসেফের এত অসাধারণ নৈপুণ্য ধরা পড়ে গেল।

মিসেস গেজ এবং তোতা খুব পরিশ্রম করে মুদ্রাগুলোকে সরিয়ে ফেলল, যার সংখ্যা ছিল তিন হাজার, বেশিও না কমও না। সেগুলো মিসেস গেজ মাটিতে তার অ্যাপ্রোনটি ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর রাখলেন। তিন হাজারতম মুদ্রাটি অ্যাপ্রোনে রাখার পর তোতাটা বিজয়ীর মতো আনন্দে বাতাসে উড়ল এবং মিসেস গেজের মাথার উপরে খুব মৃদুভাবে নামল। এরপর তারা খুব আস্তে আস্তে মিসেস ফোর্ডের কুটিরে ফিরে এলো, কারণ মিসেস গেজ খোঁড়া ছিলেন, যেমনটি আমি আগেই বলেছি। আর তাছাড়া এখন তিনি তার অ্যাপ্রোনে থাকা সম্পদের ভারে আরও ধীর হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কেউ কিছু জানা বা বোঝার আগেই তিনি সেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বাড়িটা ছেড়ে গেলেন।

পরদিন তিনি ইয়র্কশায়ারে ফিরে এলেন। মিস্টার স্টেসি তাকে আরও একবার লুইসে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং মিসেস গেজের কাঠের বাক্সটি কতটা ভারি হয়ে উঠেছে তা দেখে বরং অবাকই হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি একজন শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি শুধু এই উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে রডমেলের সদয় লোকেরা আগুনে সমস্ত সম্পত্তির ভয়ঙ্কর ক্ষতির জন্য মিসেস গেজকে সান্ত্বনা দিতে কিছু উপহার দিয়েছিল। হৃদয়বান মিস্টার স্টেসি অর্ধেক মুকুটের বিনিময়ে তোতাপাখিটাকে কেনার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, কিন্তু মিসেস গেজ একরকম ক্ষোভের সাথে তার সেই সদয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে তিনি ইন্ডিজের সমস্ত সম্পদের বিনিময়েও পাখিটা বিক্রি করবেন না। ফলে মিস্টার স্টেসি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে বৃদ্ধ এই নারী সমস্যায় ভুগে ভুগে পাগল হয়ে গেছেন।

এখন শুধু বলা যায় যে মিসেস গেজ তার নিরাপত্তার জন্য স্পিলবিতে ফিরে এসেছেন। সেখানে সাথে করে তিনি তার কালো বাক্সটি ব্যাংকে নিয়ে গেলেন এবং তোতা জেমস ও তার কুকুর শ্যাগের সাথে অনেক বয়স পর্যন্ত খুব আরাম ও সুখে বসবাস করেছিলেন।

মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকার সময় তিনি পাদ্রীকে (রেভারেন্ড স্যামুয়েল ট্যালবয়েসের ছেলে) পুরো ঘটনাটি বলেছিলেন। তিনি আরও নিশ্চিত ছিলেন যে তোতা জেমস ইচ্ছে করেই ওই বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছিল, এমনকি সে নদীর তীরে তার বিপদ সম্পর্কেও সচেতন ছিল। পাখিটা কেবল তাকে ডুবে যাওয়া থেকেই রক্ষা করেনি, বরং তিন হাজার মুদ্রার সন্ধানও দিয়েছিল, যা অন্য কোনো উপায়ে পাওয়া যেত না। এটা পশুপাখিদের প্রতি তার দয়ার পুরস্কার।

পাদ্রী ভাবল, বুড়িটা মনে মনে তার অতীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, যে মুহূর্তে মিসেস গেজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, জেমস তোতাপাখিটা চিৎকার করে উঠল, ‘বাড়িতে কেউ নেই! বাড়িতে কেউ নেই!’ সেই সঙ্গে তার দাঁড়ানোর লাঠিটা থেকে পড়ে মরে গেল। কুকুর শ্যাগও কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছিল।

রডমেলের দর্শনার্থীরা এখনও সেই বাড়িটার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পায়, যা পঞ্চাশ বছর আগে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সাধারণভাবে এটা বলা হয় যে আপনি যদি চাঁদের আলোতে এটি দেখতে যান, তাহলে আপনি শুনতে পাবেন একটি তোতাপাখি তার ঠোঁট দিয়ে ইটের মেঝেতে টোকা দিচ্ছে। অনেকেই অবশ্য সেখানে একজন বৃদ্ধ নারীকে সাদা অ্যাপ্রোন পরে বসে থাকতেও দেখেছেন।

অনুবাদঃ ফাহিমা কানিজ লাভা

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments